বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাসে তখন বসন্তের হাওয়া বইছে। চারদিকে রঙিন ফুলের সাজ, খোলা আকাশের নীলিমা—সব মিলিয়ে মন ভালো করে দেওয়ার মতো পরিবেশ। অথচ কলির মন ঠিক বিপরীত। সে এখন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো কিছুতেই মন দিতে পারে না। জীবনের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট—শিক্ষার পথ পেরিয়ে নিজের ভবিষ্যৎকে দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলা। এই ব্যস্ততা আর আত্মনিবেদন তাকে আগের মতো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটাতে দেয় না। তবুও মানুষের মন তো আর সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না; মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতি মাথা চাড়া দেয়।
একদিন ক্লাস শেষে কলি বই হাতে দ্রুত হেঁটে হলে ফিরছিল। ঠিক তখন পুকুরপাড়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার চোখে পড়ে সুমা। সে এক ছেলের সঙ্গে বেঞ্চে বসে গল্পে মগ্ন। কলি কিছুটা অবাক হয়। কারণ সুমার সঙ্গে সাধারণত নীলকেই দেখা যেত। আজ নীল নেই, অন্য একজন। দু’জনের হাসাহাসি, স্বতঃস্ফূর্ত আলাপচারিতা দেখে মনে হলো—সুমা হয়তো নতুন কারও প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। মানুষের জীবনে সম্পর্কের বদল হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু কলির মনে তবু অচেনা এক প্রশ্ন জাগল—নীল কোথায়?
সুমা তখন কলিকে লক্ষ্যই করেনি। চোখে-মুখে এমন এক গোপন উচ্ছ্বাস—যেন কারও সঙ্গে নতুন করে জীবনে পথ চলা শুরু করেছে। কলি একটু থেমে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তারপর নিজের মতো করে পথ ধরে হলে ফিরে যেতে উদ্যত হলো। ঠিক সেই সময় দূর থেকে ভেসে এলো হৈচৈ, চিৎকার আর দৌড়াদৌড়ির শব্দ। প্রথমে কী ঘটছে বুঝতে পারেনি কলি, কিন্তু কৌতূহবশত কয়েক কদম এগিয়ে তাকাতেই দেখল—নীল আর আরেকজন ছেলের মধ্যে তুমুল মারামারি চলছে।
ঘটনাটা এত হঠাৎ যে কলি মুহূর্তেই থেমে গেল। নীলের মুখ বেয়ে রক্ত ঝরছে, জামা ছিঁড়ে গেছে, তার চোখে তীব্র ক্ষোভ। অন্য ছেলেটিও কম ক্ষিপ্ত নয়। দু’জনের ধস্তাধস্তি ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। চারপাশে কিছু ছাত্র দাঁড়িয়ে হলেও কেউই এগোচ্ছিল না। অবশেষে দুই সিনিয়র ছাত্র এসে দু'জনকে আলাদা করল। নীলকে অনেকটা টেনে নিয়ে যাওয়া হলো অপর দিকের দিকে, আর অন্য ছেলেটিও সরে গেল। কেন এই মারামারি, কী নিয়ে এমন উত্তেজনা—কিছুই বুঝতে পারল না কলি।
মুহূর্তটুকু কলির মনে এক অদ্ভুত কাঁপন এনে দিল। কিন্তু সে নিজেকে আর সেখানে আটকে রাখল না। নিজের অবস্থান, পড়াশোনার চাপ, ব্যক্তিগত সীমারেখা—এসব ভেবে সে চুপচাপ হলে ফিরে গেল। নীলকে নিয়ে তার মনে হাজার প্রশ্ন ঘুরলেও সেদিন আর কিছুই জানার চেষ্টা করল না। জীবন কখনো কখনো ঠিক এভাবেই দূরত্ব তৈরির সুযোগ দেয়; মানুষ তা মেনে নেয়।
এরপর সময় গড়িয়ে গেল অনেক দ্রুত। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলো। কলি তার লক্ষ্য ধরে রাখল দৃঢ়ভাবে। অবশেষে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো—কলি দারুণভাবে সফল। পরে প্রথম শ্রেণিতে বিসিএস প্রশাসনে চাকরিও পেল। চারদিকে তার প্রশংসা, পরিবারে আনন্দ—সব মিলিয়ে নতুন জীবনের সূচনা ঘটল। তবুও তার ব্যস্ততার আড়ালেও মাঝে মাঝে নীলের কথা মনে পড়ে যেত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বন্ধু, প্রথম ভালো লাগা—এসব তো সহজে মুছে যায় না। তবে কলি কখনোই কারও কাছে এসব অনুভূতির কথা বলেনি। নিজের মধ্যে গোপন করে রেখেছিল।
এদিকে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কমে এলেও মাঝে মাঝে খবর পাওয়া যেত। একদিন এক বান্ধবীর মাধ্যমে কলি জানতে পারল—সুমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বর বিদেশে চাকরি করে, বিয়ের পর সুমাও বিদেশে চলে যাবে। খবরটা শুনে কলি অবাক হলো না, কারণ সে আগেই বুঝেছিল সুমার ভেতরে কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবে নীলের বিষয়ে কারও কাছ থেকেই কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। পাশ করার পর নীল যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কোথায় আছে, কী করছে—কেউই জানে না।
কলির মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে—নীল কি কখনো তার কথা ভাবে? সেই পুকুরপাড়ের হাসিমুখ, সেই বই ভাগাভাগি করে পড়া, সেই অকারণ রাগ-অভিমান—সবই কি নীলের কাছে হারিয়ে গেছে? নাকি সময়ের স্রোতে মুছে যাওয়া নিঃশব্দ ছায়ার মতো সেও এক অচেনা দূরত্বে হারিয়ে গেছে?
অজানা প্রশ্নগুলো উত্তরহীনই থেকে যায়। কিন্তু জীবন তো চলছেই—নিজস্ব গতিতে, নিজস্ব নিয়মে। আর কলি সেই গতিতেই এগিয়ে যেতে থাকে, ভবিষ্যতের পথে। চলবে-----
নিঃশব্দ ছায়া — পর্ব ১৩
সময় কত দ্রুত বদলে যায়! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেই চঞ্চল, স্বপ্নবাজ নীলটি এখন অনেকটাই বদলে গেছে। পড়াশোনা শেষ করে বড় কিছু করবে—এমন স্বপ্ন সে দেখেছিল ঠিকই, কিন্তু বাস্তব জীবন তাকে ভিন্ন পথে নিয়ে এসেছে। বহুদিন ধরে নীল কোনো চাকরি পাচ্ছে না। কয়েকবার পরীক্ষা দিয়েছে, কিছু জায়গায় ভাইভাও দিয়েছে, কিন্তু কোথাও সুযোগ হয়নি। আত্মবিশ্বাসটা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। হতাশা তাকে গ্রাস করলেও বাইরে কাউকে বোঝতে দেয় না।
শেষ পর্যন্ত সে শহরের ব্যস্ততা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতেই থাকতে শুরু করল। বাড়িতে এখন শুধু তার মা—বাবা মারা গিয়েছেন অনেক আগেই। মায়ের বয়স হয়েছে, শরীরও ভালো না; ভারী কাজ তো দূরের কথা, সামান্য হাঁটাহাঁটিও কষ্টকর। এমন অবস্থায় নীলই ঘর-দুয়ার, বাজার-সদাই, জমি-জমার ছোটখাটো কাজগুলো সামলে নেয়। ইচ্ছে থাকলেও চাকরির খোঁজে বাইরে বেরোনো সম্ভব হয় না প্রতিদিন। তাছাড়া গ্রামে থাকলে খরচও কম হয়—এই হিসাবেই যেন দিন কাটছে।
নতুন বছর শুরু হতেই জমি-জমার খাজনা হালনাগাদ করার সময় হলো। বাবার সময় এসব কাজ তিনি দেখতেন। নীল এসব বিষয়ে প্রায় কিছুই জানে না। তবুও দায়িত্ব তারই—মায়ের চোখে ভরসা একমাত্র ছেলেটিই। কাগজপত্র গুছিয়ে সে তহশিল অফিসে গেল। প্রথম দিনেই বুঝলো, কাজটা মোটেও সহজ নয়। অফিসের এক ডেস্ক থেকে আরেক ডেস্কে পাঠানো, নতুন করে ফরম আনা, নথিপত্র মিলিয়ে দেখা—এ যেন অন্তহীন দৌড়ঝাঁপ। তহশিলের কর্মচারীরা নানা অজুহাতে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ক্লান্ত করে তুলছিল। কেউ বলছে সই মেলেনি, কেউ বলছে নামজারি হয়নি, কেউ আবার বলছে ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না। দিনের পর দিন নীল এভাবে ঘুরে ফিরে শুধু হতাশই হচ্ছিল।
অবশেষে সে ঠিক করল—যা হোক, এবার ভুমি অফিসে সহকারী কমিশনারের সাথে সরাসরি দেখা করবে। বড় কর্তার সামনে বিষয় ব্যাখ্যা করলে হয়তো সমস্যার সমাধান মিলবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নীল আর দেরি করল না। সপ্তাহের শুরু, রবিবার ভোরবেলা স্নান করে, কাগজপত্র একটি পুরোনো ফাইলে ভরে সে রওনা হলো উপজেলা ভুমি অফিসের দিকে।
শীতের সকালের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি। কাদামাখা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নীলের মনে অদ্ভুত এক উদ্বেগ কাজ করছিল—যদি সাক্ষাৎ না পাওয়া যায়? যদি সমস্যাটা আরও জটিল হয়? তবে ভয়কে মাথায় না নিয়ে সে অফিসে গিয়ে প্রথমেই সাক্ষাতের অনুমতি চাইল। কয়েকজন কর্মচারীর তদবির, অপেক্ষা, বারবার প্রশ্ন—এসব সামলে শেষে সে জানতে পারল, সহকারী কমিশনার (ভুমি) তাকে সাড়ে বারোটায় সময় দেবেন।
সময়ের বেশ আগেই নীল গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অপেক্ষার ঘরটিতে লোকজন কম নয়—কেউ খাজনা দিতে এসেছে, কেউ নামজারি, কেউ আবার জমির বিরোধ নিয়ে। নীল তাদের মুখ দেখে অনুভব করল, এই কাগজপত্র আর আইনকানুন মানুষের জীবনে কত ঝামেলা তৈরি করে। তবুও—দায়িত্ব তো এড়ানো যায় না।
ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। অবশেষে সাড়ে বারো বাজতেই পিয়ন এসে ডাকল—“আপনি ভেতরে যেতে পারেন।” নীল উঠে দাঁড়াল। ফাইলটা শক্ত করে হাতে চেপে দরজার দিকে এগোলো। বুকের ভেতর কেমন যেন ধুকপুকানি—কীভাবে কথা শুরু করবে, কীভাবে বলবে সমস্যার কথা—এসব ভাবতে ভাবতেই দরজার হাতল ঠেলে ভেতরে ঢুকল নীল।
আর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ স্থির হয়ে গেল। অফিসের চেয়ারে বসে থাকা সহকারী কমিশনার—কলি!
নীলের শ্বাস যেন এক মুহূর্তের জন্য আটকে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ব্যস্ত দিনগুলো, পুকুরপাড়ে কাটানো বিকেল, নীরব দৃষ্টির ভাষা—সবকিছু যেন হঠাৎ তার মনে ফিরে এলো। কলিও তাকিয়ে রইল বিস্মিত চোখে। কয়েক সেকেন্ড কেউই কিছু বলতে পারল না। তারপরই কলির চোখে স্পষ্ট চমক, যেন অতীত হঠাৎ ফিরে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে।
কলি ধীর গলায় বলল—
“আপনি… নীল?”
ওর কণ্ঠে বিস্ময়, কিছুটা দ্বিধা, আর অনেকটা অচেনা আবেগ। সেই পরিচিত মুখ, দৃঢ় ভঙ্গি—কিন্তু এখন দায়িত্বের মর্যাদায় আরও পরিণত, আরও আত্মবিশ্বাসী।
নীল মাথা নিচু করে বলল,
“হ্যাঁ… আমি। কিছু জমির সমস্যা নিয়ে এসেছি।”
কলি সামলে নিয়ে পেশাদারিত্বের ভঙ্গিতে বলল—
“বসুন, সব বলুন। দেখি কী করা যায়।”
নীল ধীরে ধীরে চেয়ারে বসল। ফাইল খুলতে খুলতে তার হাত কেঁপে উঠছিল। যেন জমির সমস্যা নয়—নিজের বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া অতীতটাই আজ কলির সামনে তুলে ধরছে।
অফিসের ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল—কাগজের মৃদু শব্দ আর দু’জন মানুষের অচেনা নীরবতা সেখানে একইসঙ্গে ধ্বনিত হচ্ছিল।
—চলবে।