কলি এবার নিজের মনেই এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। নীলের সঙ্গে আর দেখা করবে না, কথা বলবে না—এমনকি তার নাম শুনলেও যেন হৃদয় দুলে না ওঠে। গত কয়েক সপ্তাহের অস্থিরতা তাকে এতটাই ক্লান্ত করে তুলেছে যে, সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে শুধু পড়াশোনায় ডুবে যাওয়াই এখন তার একমাত্র পথ।
পরীক্ষা সামনে। এই পরীক্ষার ফলাফলের ওপরই নির্ভর করছে তার ভবিষ্যৎ, তার স্বপ্ন, তার সংগ্রাম—সবকিছু। কলির লক্ষ্য প্রশাসনের উচ্চপদস্থ চাকরি; ছোটবেলা থেকেই বাবাকে বলতে শুনেছে, “জীবনে বড় কিছু হতে হলে নিজেকে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে হয়।” সেই বাক্য যেন মনে গেঁথে গেছে। তাই নীল যতই মনে জায়গা করে নিয়ে থাকুক, এখন তার সামনে কেবলই বইয়ের পাহাড়, নোটের বাণ্ডিল আর অসীম অনুশীলন।
কলি প্রতিদিন ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠে। পড়ার টেবিলের সামনে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীলনী সমাধান করে। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকে তার চুল এলোমেলো করে দেয়, কিন্তু সে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় না। বাইরে কী ঘটছে, কে কোথায় যাচ্ছে—আজকাল এসব নিয়ে তার আর কোনো আগ্রহ নেই। যেন পৃথিবী ছোট হয়ে কেবল তার টেবিল, বই আর লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।
এদিকে নীল গত কয়েকদিন ধরে একটানা ফোন করছে। প্রথম দিকে প্রতিটি কলের শব্দে কলির মন কেঁপে উঠত। মনে হত, ফোনটা ধরেই বলে দেয়—“নীল, আমি পড়ছি, পরে কথা বলবো।” কিন্তু পরে সে নিজেকে বোঝালো—ফোন ধরলে আবার কথাবার্তা বাড়বে, আবার মন অন্যদিকে যাবে, আবার এই প্রস্তুতির সময়টা নষ্ট হবে। তাই ফোনের স্ক্রিনে নীলের নাম উঠলেই সে নিঃশ্বাস চেপে রেখে ফোনটা নীরবে সাইলেন্ট করে রাখে। ধীরে ধীরে কলি অভ্যস্ত হয়ে গেল নীলের নাম দেখেও সাড়া না দিতে।
কয়েকদিন আগে রিকশায় করে কোচিং থেকে ফিরছিল সে। সন্ধ্যার আলোর নরম ছায়ায় ব্যস্ত রাস্তাটা তখনো মানুষের ভিড়ে সরগরম। হঠাৎ সামনে পরিচিত এক ছায়ার মতো অবয়ব ভেসে উঠল—নীল। তাকে দেখেই নীল উচ্ছ্বাসভরে ডাকল, “কলি! কলি, একবার দাঁড়াও… কথা আছে!” কিন্তু কলি যেন কিছুই শুনল না। মুখ ঘুরিয়ে বিপরীত দিকে তাকিয়ে রইল। রিকশা এগিয়ে যেতে লাগল, আর নীলের কণ্ঠ ধীরে ধীরে পেছনে মিলিয়ে গেল।
সেদিন রিকশায় চেপে বসে কলির বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, নীলের মুখ দেখে ফেললে তার কঠিন প্রতিজ্ঞা কোথায় যেন হারিয়ে যাবে। তাই নিজের চোখ দুটোকে সে ইচ্ছে করে শক্তভাবে বন্ধ করেছিল। মনে মনে বলেছিল— “না কলি, ভুলবে না। তুমি যে পথে হাঁটছ, সেখানে আবেগকে জায়গা দিলে চলবে না।”
রাতে পড়ার টেবিলের সামনে বসে যখন বই খুলল, তখন নীলের ডাকে অনুচ্চারিত এক ব্যথার মতো শব্দ কানে বাজছিল। কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করে সামলে নেয়। কাঁধ সোজা করে ঠান্ডা গলায় ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে—“মন দুর্বল হলে স্বপ্ন ভেঙে পড়ে। আমি দুর্বল হবো না।”
দিন কেটে যায়। কলি পড়াশোনায় আরও গভীরভাবে নিমগ্ন হয়। তার এই নিরবতা শুধু নীল নয়, চারপাশের সবাইকেই অবাক করে তুলেছে। সবার চোখে এখন সে যেন অন্য এক মানুষ—সংযত, মনোযোগী, এবং নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অবিচল।
তবু নীরবতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে একটুকরো অস্বস্তি। কখনো কখনো রাতের বেলা পড়তে পড়তে যখন জানালার বাইরে চাঁদের মোলায়েম আলো পড়ে, সে মনে করে—নীল কি আজও তাকে ফোন দিচ্ছে? নীল কি এখনো অভিমান করে আছে? নাকি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছুর দিকে মন দিয়েছে? এসব প্রশ্ন মাঝে মাঝে বুকের ভেতর হালকা ঝড় তোলে। কিন্তু কলি এই ঝড়কে ঠেকাতে জানে। চোখ শক্ত করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন নিজের ভিতরের সব দ্বিধাকে অস্বীকার করছে।
পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। প্রতিদিন দ্বিগুণ পরিশ্রম করছে কলি। ভোর থেকে রাত—তার সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত এখন নিজের স্বপ্নের দিকে এগোনোর সিঁড়ি। সে জানে না ভবিষ্যৎ কী অপেক্ষা করে আছে, নীল কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কিংবা তারা আবার কখনো কথা বলবে কিনা।
কিন্তু সে এতটুকু জানে—এই মুহূর্তে, এই সময়ে, তাকে নিজের পথেই হাঁটতে হবে। আর সে পথটাই তাকে বদলে দিচ্ছে—শব্দহীন নিঃশব্দ ছায়ার মতো দৃঢ় আর অনমনীয় করে তুলছে। চলবে---
নিঃশব্দ ছায়া
পর্ব -১১
পরীক্ষা একেবারে দরজায় কড়া নাড়ছে। কলির দিনগুলো এখন সময়ের সঙ্গে যুদ্ধের মতো। ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙে, ছয়টার মধ্যে কালো কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সে টেবিলে বসে যায়। নোট, প্রশ্নব্যাংক, অনুশীলনী—সবকিছুই যেন তার মাথার চারপাশে এক অদৃশ্য বলয়ের মতো ঘুরে বেড়ায়। তবে খেয়াল করলে বোঝা যায়, যতই ব্যস্ততার চাপে ডুবে থাকুক, তার ভিতরে এক ছোট্ট জায়গায় এখনো নীরব একটা শূন্যতা রয়ে গেছে। সেই শূন্যতার নাম—নীল।
কিন্তু কলি নিজেকে বোঝাতে শিখেছে। সে জানে, জীবনে বড় হতে হলে কিছু সিদ্ধান্ত কঠিন হয়, কষ্টের হয়—তবুও নিতে হয়। এই কঠোরতা তাকে বদলে দিয়েছে। মায়ের চোখে মেয়েটিকে যেন এখন আরও পরিণত, আরও দৃঢ় মনে হয়। মা মাঝেমধ্যে চিন্তাও করেন—কলি কি নিজের ওপর বেশি চাপ নিচ্ছে? রাতে খাবার টেবিলে মা বলেছিলেন,
—“এই যে এত চাপ নিচ্ছিস, শরীর খারাপ করে ফেলবি না তো?”
কলি হেসে বলেছিল,
—“না মা, আমার আর সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। লক্ষ্যটা কাছে, আমি হাল ছাড়ব না।”
এদিকে নীলের চেষ্টা থেমে নেই। প্রথমদিকে সে ফোন করত বারবার, এখন ফোন করে কম, কিন্তু মেসেজ পাঠায়—“কেমন আছ?”, “কথা বলবে?”, “আমি একবার দেখা করতে চাই”…
কিন্তু কোনো উত্তর পায় না। চ্যাটবক্সে কলির নীরবতা যেন একটা ইটের দেয়াল। তবু নীল হাল ছাড়ে না। মাঝেমধ্যে কোচিংয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, হয়তো কোনোদিন হঠাৎ কলিকে দেখতে পাবে—এই আশা নিয়ে।
একদিন বিকেলে পড়তে পড়তে হঠাৎ কলির বুক কেঁপে উঠল। ফোনে নীলের মেসেজ—
“কলি, কি এতটা দূরে চলে গেলি? শুধু একবার কথা বলার সুযোগ দিবি না?”
কলি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার ভিতরের দেওয়ালটা দুলে উঠল। মনে হল, হয়তো একটা উত্তর দিলে ক্ষতি নেই। কিন্তু নিজেরই উচ্চারণ শোনা গেল,
—“না কলি, তুমি এখন দুর্বল হতে পারবে না।”
ফোনটা চুপচাপ টেবিলের ওপর রেখে আবার বইয়ের দিকে মুখ ফেরাল সে।
সেদিন রাতে হঠাৎ মাতলামো, কান্না কিংবা অভিমান নয়—বরং এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা কলির মনে চেপে বসেছিল। পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে আছে, জানালার বাইরে জোনাকি ভাসছে, আর টেবিল ল্যাম্পের নরম আলোতে সে শুধু একটানা লিখে চলেছে। কিন্তু মন তার পড়ায় নেই। মনে হচ্ছিল, নীলের ডাকই যেন কোথাও প্রতিধ্বনির মতো ঘুরে ফিরছে।
অবশেষে সে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। ভাবল—নীল কি সত্যিই তাকে বুঝতে পারত? তার স্বপ্ন, তার সংগ্রাম, তার ভয়… এই সব কিছু কি কখনো নীলের চোখে ধরা পড়েছিল?
কিন্তু পরক্ষণেই সে নিজেকে ধমকাল—
“এখন এসব ভেবে লাভ কী? তুমি পথ বদলালে সব শেষ। থামা যাবে না।”
পরের দিন সকালে কোচিংয়ে যাওয়ার পথে অদ্ভুত কিছু ঘটল। রিকশা স্টপের পাশে দাঁড়াতেই কলি দেখল—নীল কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে। খুব সাধারণ পোশাক, চোখে ক্লান্তি, তবুও মুখে একটি শান্ত হাসি।
নীল ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। কলির দিকে কোনো অনুরোধ নয়, শুধু নরম কণ্ঠে বলল—
—“আমি কথা বলব না। শুধু দেখে নিলাম, ভালো আছ কিনা।”
কলি কঠিন হয়ে গেল। তার মনে অস্থিরতা, কিন্তু মুখে শীতলতা।
—“নীল, প্লিজ… এখন আমি এসবের মধ্যে যেতে চাই না।”
নীল মাথা নত করল।
—“ঠিক আছে। তোর লক্ষ্যটাই বড়। আমি আটকে থাকতে চাই না। শুধু এটুকু জানিস, তোকে বিরক্ত করব না আর।”
কথা শেষ করে সে চলে গেল। খুব ধীরে, খুব নীরবে।
কলির মনে হল, যেন কেউ একটা দড়ির টান কেটে দিল। বুকটা ভারী হয়ে উঠল। কিন্তু সে কোনো শব্দ করল না। রিকশায় উঠে সোজা সামনে তাকিয়ে রইল। তার চোখে জল ছিল না, কিন্তু মনে হচ্ছিল কোনো ক্ষুদ্র শব্দে সে ভেঙে পড়বে।
সে জানে না নীলের এই নীরব বিদায় তার পথ সহজ করে দিল, নাকি আরও কঠিন করে তুলল।
তবে এক জিনিস সে খুব স্পষ্ট বুঝল—
স্বপ্নের পথে হাঁটা শুধু পরিশ্রমের নয়, ত্যাগেরও পরীক্ষা।
আর এই পরীক্ষাই তাকে আরও শক্ত করে তুলছে, নিঃশব্দ ছায়ার মতো গভীর আর অনমনীয়। চলবে-----