২০০৯ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার হিসেবে মাত্র ৫১০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। এরপর ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সহকারী একান্ত সচিব-২ পদে পদোন্নতি পান। এই পদই হয়ে ওঠে আলাদিনের চেরাগ। এই চেরাগ ঘষেই বনে যান কোটিপতি। ২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর রিটার্নের তথ্য অনুযায়ী তার বেতন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৬৭ হাজার ১০ টাকা। তবে বেতন যাই হোক, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চাকরি পাওয়ার পর আর পেছনে ফিরতে হয়নি। বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে নামে বেনামে গড়েছেন শত শত কোটি টাকার সম্পদ। রাজধানীতে রয়েছে একাধিক বহুতল বাড়ি, ফ্ল্যাট, গোপালগঞ্জে বাণিজ্যিক স্পেস। কাশিয়ানীতে স্ত্রীর নামে এগ্রোফার্ম, কোটালীপাড়ায় মাছের ঘের, পরিবহন খাতেও রয়েছে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ। কুয়াকাটায় ভাইয়ের নামে ওশান ব্লু রিসোর্ট। বন্ধু শামিম খান নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে দুবাইয়ে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। শ্যালকের স্ত্রীর নামে গোপালগঞ্জে রয়েছে ১০ তলা স্বর্ণা টাওয়ার। ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিতে রয়েছে বিপুল টাকার এফডিআর। মাত্র ৫১০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া ওই ব্যক্তির নাম গাজী হাফিজুর রহমান লিকু। গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) লিকুর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে, গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর নামে-বেনামে নিজ ও বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল সম্পদ রয়েছে। তার অবৈধভাবে অর্জিত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া দুবারের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. সৌমিত্র শেখরের নামেও দুর্নীতির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর ২০২৩-২৪ আয়কর বর্ষের তথ্যনুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৩ লাখ ৭৪ হাজার ২৯৭ টাকা। সম্পদের মধ্যে রয়েছে, গোপালগঞ্জ পৌরসভায় ২২ লাখ টাকা মূল্যের ১০ শতক জমি, ঢাকার উত্তরায় ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার সরকারি প্লট। জীবন বীমায় বিনিয়োগ ১৫ লাখ ৪০ হাজার ৪০৭ টাকা, স্বর্ণ ৬০ ভরি। এসব স্বর্ণ উপহার হিসেবে দেখানো হলেও মূল্য লেখা নেই। আসবাবপত্র ৫০ হাজার টাকা, ইলেকট্রনিকস ৫০ হাজার টাকা, হাতে নগদ ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮৩ টাকা, ব্যাংকে ৭৫ হাজার ৩৭৬ টাকা এবং পিস্তল ও শটগান ১ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। তবে আয়কর রিটার্নে এসব সম্পদ থাকলেও লিকুর নামে-বেনামে স্ত্রী,শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী, ভাই ও বন্ধুদের নামে রয়েছে শত শত কোটি টাকার সম্পদ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্ট্যান্ডার্ড চ্যার্টার্ড ব্যাংকে লিকুর ১০ লাখ ২১ হাজার ২৮৮ টাকা জমা ছিল। সেখান থেকে স্ত্রী রহিমা আক্তারের নামে গতবছর ২৫ জুন ৫ লাখ টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছে। এ ছাড়া মেট লাইফ এলিকোতে ২৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকার পাঁচটি পলিসি রয়েছে। স্ত্রী রহিমা আক্তারের নামে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানাধীন রামদিয়াতে ‘মেসার্স রাফি এগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ’ নামে একটি এগ্রো ফার্ম রয়েছে। এগ্রো ফার্মে মোট জমির পরিমাণ ৪৭০ শতক। এসব জমি ‘মেসার্স রাফি এগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ’-এর নামে কেনা হয়েছে। জমির মধ্যে আমজাদ মোল্লা গংদের কাছ থেকে কাশিয়ানী থানা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ১৩/০৬/২৪ তারিখের ৬/২৪ নং রেজিস্ট্রি দলিলে ১৭.৭১ শতাংশ জমি ক্রয় করা হয়েছে। দলিল মূল্য ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা দেখালেও প্রকৃত মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। একই রেজিস্ট্রি অফিসে ১/০২/২৩ তারিখের ৬৭৯/২৩ নং রেজিস্ট্রি দলিলে ছাওবান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২৪৯.৮৫ শতাংশ জমি ক্রয় করা হয়েছে। দলিল মূল্য ২৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা দেখালেও প্রকৃত মূল্য প্রায় ৯০ লাখ টাকা। একইভাবে রানু বেগমের কাছ থেকে ৮৫ শতক, হাচিনা বেগমের কাছ থেকে ৩০.৭৫ শতাংশ, রহিমা বেগমের কাছ থেকে ২৩ শতাংশ, শাহাদাৎ হোসেনের কাছ থেকে ৫২ শতাংশ, শওকত আলীর কাছ থেকে ১১.৭৩ শতাংশসহ মোট প্রায় ৪৭০.০৪ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। প্রতিটি জমিতেই প্রকৃত মূল্যের চেয়ে দলিল মূল্য অনেক কম দেখানো হয়েছে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও সদর থানায় ৪০০ বিঘা জমিজুড়ে একটি মৎস্য ঘের রয়েছে। গোপালগঞ্জের সদর থানাধীন থানাপাড়া রোডে (ডিসি রোড) পৈতৃক জমিতে ৫ তলা একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। গোপালগঞ্জ পৌরসভার প্ল্যানে বাড়িটির হোল্ডিং মালিক গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর মা রিজিয়া বেগম। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলায় মধুসিটিতে এক বিঘা জমির ওপর ৬ তলা একটি আলিশান বাড়ি রয়েছে লিকুর। আদাবরের ৬ নম্বর রোডের ৫৮৩ নম্বর বাড়িতে এ-৬ ফ্ল্যাটের মালিক লিকুর স্ত্রী রহিমা আক্তার। ২৫ মিতালী রোড, আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক, ধানমন্ডিতে আরও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। কুয়াকাটার লাইট হাউসের পাশে ‘ওশান ব্লু রিসোর্টে’ লিকুর সেজো ভাই গাজী মুস্তাফিজুর রহমান দিপুর শেয়ার রয়েছে। গোপালগঞ্জের সদর থানাধীন অনির্বাণ স্কুলের দক্ষিণ পাশে ৩৪ খ্রিষ্টানপাড়ায় (ওয়ার্ড-৬) ১০ শতাংশ জমিতে ৬ তলার প্ল্যান পাস করে অবৈধভাবে ৭ তলা ভবন নির্মাণাধীন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এই একান্ত সচিবের বেনামেও একাধিক বাড়ি রয়েছে। বেনামে বাড়ির মধ্যে রয়েছে—গোপালগঞ্জের সদর থানাধীন পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে উত্তর গোবরা নামক স্থানে ১৪ শতক জমিতে ২ তলা ডুপ্লেক্স বাড়ি, একই স্থানে ৩ তলা আরও একটি বাড়ি, গোপালগঞ্জ সদর থানাধীন পৌরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে সোনাকুড় নামক স্থানে নিলেরমাঠের পাশে ১০ শতাংশ জায়গায় ১ তলা একটি বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ পৌরসভায় ছোট ভাই গাজী শফিকুর রহমান ছোটনের নামে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে থানাপাড়ার বকুলতলায় খ্রিষ্টানদের কবরস্থানের পাশে ২২ শতাংশ ভূমি ক্রয়; ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে শ্যালকের নামে ৭ কাঠা ভূমি ১.২৫ কোটি টাকায় ক্রয়, গোপালগঞ্জের বেদগ্রাম মোড়ে বেদগ্রাম মৌজার হোল্ডিং নং ৫৯৬/৭-এ স্ত্রী রহিমা বেগমের নামে ৮ শতাংশ বসতভিটা ক্রয় ও হোল্ডিং নং ১০৮/৩-এ ১০ শতাংশ বসতভিটা ক্রয়। গোপালগঞ্জ পৌরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হুমায়ুনের কাছ থেকে ১৫ বিঘা জমি শ্যালক হালিমের নামে কিনে পুকুর খনন করে খামার বানিয়েছে। ভায়রা ভাই ওমর আলীর নামে পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ তলা বাড়ি নির্মাণ করেছে। এ ছাড়া নিজ বাড়ির পাশে থানাপাড়া রোডের অনির্বাণ স্কুলের দক্ষিণ পাশে শ্যালক শেখ মো. ইকরাম ওরফে হালিম মোল্লার নামে ৬ তলা বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন লিকু। যেখানে তার শ্বশুর-শাশুড়ি বসবাস করেন। গোপালগঞ্জ পৌরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে সোনাকুড় নামক স্থানে নিলেরমাঠের পাশে ১৩ শতাংশ জমির ওপর লিকুর শ্যালক শেখ মো. ইকরাম ওরফে হালিম মোল্লা ও তার স্ত্রী স্বর্ণা খানম (বেনামে) নামে গড়ে তুলেছেন কমার্শিয়াল ও আবাসিক ১০ তলা স্বর্ণা টাওয়ার। এ ভবনে রয়েছে আধুনিক সুইমিংপুলসহ মোট ৪০টি ফ্ল্যাট। ২০১৫ সালে সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসরে দলিল নম্বর ২০০৮ মূলে ১৩ শতাংশ ভূমি নূরে এলাহীর কাছ থেকে ক্রয় করে ২০১৯ সালের ২১ জুলাই ৬ তলা ভবরনের প্ল্যান পাস করে বর্তমানে অবৈধভাবে ১০ তলা সম্পন্ন করছেন। জমির ক্রয়মূল্য মাত্র ১৭ লাখ টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত মূল্য কয়েক কোটি টাকা।