ঢাকা, শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫,
সময়: ০২:০৮:০৩ AM

শাহবাগে গর্জন:৩০ দলীয় জোটের ঘোষণা

স্টাফ রিপোটার।।দৈনিক সমবাংলা
05-09-2025 09:34:53 PM
শাহবাগে গর্জন:৩০ দলীয় জোটের ঘোষণা

ঐক্য ও প্রতিবাদের ঐতিহাসিক আবহে শুক্রবার সন্ধ্যায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে রূপ নেয় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে। গণঅধিকার পরিষদের (গোপ) ব্যানারে আয়োজিত এই মহাসমাবেশ, নাম দেওয়া হয় ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী সংহতি সমাবেশ’। ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে এই সমাবেশে এক কণ্ঠে উচ্চারিত হয়—
“বাংলাদেশে আর ফ্যাসিবাদ নয়—শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অধ্যায় চিরতরে শেষ।”


তিন দফা দাবি: জাপা নিষিদ্ধ, হামলার বিচার, উপদেষ্টার পদত্যাগ

গণঅধিকার পরিষদ সমাবেশে যে তিন দফা দাবি তোলে তা হলো:
১. অবিলম্বে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও ১৪ দলীয় জোট নিষিদ্ধ ঘোষণা।
২. গোপ সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর নৃশংস হামলার বিচার।
৩. নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় স্বরাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার পদত্যাগ।

যদিও তিনটি দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হয়, বক্তৃতার প্রায় পুরোটাজুড়ে ছিল জাপা নিষিদ্ধের জোরালো আহ্বান। বক্তারা অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনার “অদৃশ্য অনুগামীরা” প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে বসে বিরোধী নেতাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ নুরের ওপর আক্রমণ।


“শেখ হাসিনার অধ্যায় শেষ”

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল মঞ্চে উঠে ঘোষণা দেন:
“জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়েছে। তাকে আবার ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন জাপা দেখছে, তারা বিভ্রান্ত। শেখ হাসিনার অধ্যায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে শেষ।”

তিনি আরও অভিযোগ করেন, ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেখ হাসিনার প্রভাবশালী অনুগামীদের এখনও সরাতে ব্যর্থ হয়েছে।
তার ভাষায়: “যদি এই অবশিষ্ট ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মূল থেকে উৎপাটন না করা যায়, তবে আবারও ফ্যাসিবাদের পুনর্জন্ম ঘটবে। আর তাদের জন্য এখন আর হোমিওপ্যাথি নয়—সার্জিক্যাল চিকিৎসা প্রয়োজন।”


নুরের ওপর হামলায় ক্ষোভের বিস্ফোরণ

গোপ সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা সমাবেশকে উত্তাল করে তোলে।
জামায়াতে ইসলামী সহকারী মহাসচিব অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন,
“নুরের ওপর হামলা মানে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ওপর হামলা।”

গোপ সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন,
“নুর হাসপাতালে শয্যাশায়ী, অথচ কোনো হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সরকারি তদন্ত কমিটি প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। স্বরাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা পদত্যাগ না করলে সচিবালয় অবরোধ করা হবে।”


ঐক্যের ডাক: বিভাজন নয়, সংহতি

ডানপন্থী ইসলামপন্থী দল থেকে শুরু করে বামপন্থী প্রগতিশীল শক্তি—সবাই এক মঞ্চে উঠে ঐক্যের বার্তা দেয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম প্রধান সংগঠক মোহাম্মদ আতাউল্লাহ বলেন,
“জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু নুরের ওপর হামলা প্রমাণ করছে আমাদের মধ্যে বিভাজনের ষড়যন্ত্র চলছে। বিভক্ত হলে আবার ফ্যাসিবাদ ফিরবে।”

ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ সতর্ক করে বলেন,
“হাসিনার অনুগামীরা এখনও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছে। জাপা নিষিদ্ধ না হলে বাংলাদেশ ফের অস্থিতিশীলতার পথে যাবে।”


কঠোর হুঁশিয়ারি: “ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন নয়”

সবচেয়ে কঠোর বক্তব্য আসে হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিশ ও কয়েকটি বামপন্থী দলের কাছ থেকে।
খেলাফত মজলিশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন:
“নুরের ওপর হামলা মানে ১৬ বছরের মুক্তির সংগ্রামের ওপর হামলা। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়েছে—এখন জাপা ও ১৪ দলীয় জোটকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। শেখ হাসিনার রাজনীতিকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা হলে তাদের জন্য বাংলাদেশে কোনো স্থান থাকবে না।”

বামপন্থী দলগুলোর নেতারাও আওয়ামী লীগ, জাপা ও ১৪ দলকে একযোগে অভিযুক্ত করে বলেন—তাদের হাত ধরেই গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে।


চাপের মুখে ড. ইউনুস সরকার

বিএনপিসহ কয়েকটি দলের নেতারা ড. মুহাম্মদ ইউনুস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সরাসরি সমালোচনা করে বলেন, শেখ হাসিনার গভীর শেকড়বদ্ধ অনুগামীদের তারা এখনো সরাতে পারেনি। তাদের মতে, এই অবস্থা চলতে থাকলে আবারও বিরোধী নেতাদের ওপর হামলা ঘটবে।

বার্তা ছিল স্পষ্ট—অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এখনই পক্ষ বেছে নিতে হবে: গণতন্ত্র নাকি ফ্যাসিবাদ।


নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা

সমাবেশ শেষে হাজারো নেতাকর্মী হাত উঁচিয়ে প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করেন:
“বাংলাদেশে আর কোনোদিন ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে না। আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শাহবাগের এই সমাবেশ দেশের রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। অন্যদিকে ৩০ দলীয় জোট এখন একটি শক্তিশালী মঞ্চে পরিণত হয়েছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও হাসিনা অনুগামীদের জন্য সরাসরি বার্তা।


উপসংহার

শাহবাগে শুক্রবারের এই মহাসমাবেশ কেবল প্রতিবাদের ঢেউ নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। ঐক্য, প্রতিরোধ ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার নিয়েই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই ঐতিহাসিক শপথ উচ্চারিত হলো।