ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ০৯:১০:৩৪ AM

বিএনপি–জামায়াত সম্পর্কে তীব্র অস্থিরতা

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
10-12-2025 03:10:08 PM
বিএনপি–জামায়াত সম্পর্কে তীব্র অস্থিরতা

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অল্প সময়ের মধ্যেই নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের পলায়ন ও সাংগঠনিক বিপর্যয়ের ফলে বহু বছর পর ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা জোরালো হয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগে নিজস্ব প্রভাব-ক্ষেত্র নির্মাণে বেগ পেতে হচ্ছে দুই পুরোনো রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকেও। একসময় যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছে, সেই দুই দলের সম্পর্ক এখন রূপ নিয়েছে প্রকাশ্য বৈরিতায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগবিহীন রাজনৈতিক মাঠে এখন মূল দ্বন্দ্ব বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেই। একই লক্ষ্য—ক্ষমতার কেন্দ্রে নতুন প্রভাব বিস্তার—এখন দুই পক্ষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একদিকে রয়েছে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক কাঠামোর অবশিষ্ট প্রভাব ও সাইবার প্রচারণা; অন্যদিকে জামায়াতের নতুন রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশল, যা বিএনপির জন্য নতুন ধরনের চাপ তৈরি করেছে।

তারেক রহমানের বক্তব্যে দ্বন্দ্বের বিস্ফোরণ

৭ ডিসেম্বর বিএনপির ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যই এই দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে এনে দেয়। যদিও তিনি সরাসরি জামায়াতের নাম উচ্চারণ করেননি, তবে বক্তব্যে দলটির বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ঝরে পড়ে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, দেশের মানুষ ইতোমধ্যেই ইতিহাসের বিচার করেছে। তারেকের ভাষায়, “তারা কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে, মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে, তা জাতি ভুলে যায়নি।" একইসঙ্গে তিনি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগের সহিংসতাকে তুলনা করেন মুক্তিযুদ্ধকালীন নৃশংসতার সঙ্গে।

রাজনৈতিক মহলে তারেক রহমানের এই বক্তব্যকে অনেকেই বিএনপি–জামায়াত সম্পর্কের ‘ব্রেকিং পয়েন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। কারণ এর আগে দুই দলের মধ্যে এত উচ্চমাত্রার প্রকাশ্য বাকযুদ্ধ দেখা যায়নি।

বিএনপির অভিযোগ: জামায়াত আওয়ামী লীগপন্থী কৌশল নিচ্ছে

বিএনপি অভিযোগ করছে, তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত এখন কৌশলে আওয়ামী লীগের সমর্থক ভোটব্যাঙ্ক টার্গেট করছে এবং পরোক্ষভাবে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া তৈরির চেষ্টা করছে।

নাটোরে এক সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, “যারা গত ১৫ বছর আমাদের ওপর হামলা-গুলি চালিয়েছে, সেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টা এখন স্পষ্ট।” তিনি জনগণকে সতর্ক করে বলেন, এই রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিরোধে বিএনপিকেই সামনে আসতে হবে।

বিএনপির নেতারা মনে করছেন, জামায়াত তাদের ঐতিহ্যগত মিত্রতার বোঝা ঝেড়ে ফেলে স্বাধীন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইছে। এমনকি এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের ভোটারদের টার্গেট করে নতুন রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের চেষ্টা চলছে।

জামায়াতের পাল্টা ব্যাখ্যা: “আমরা স্বাভাবিক রাজনীতির অধিকার চাই”

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী নেতারা বিএনপির অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, তারা কেবল নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করতে চায়। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গণমাধ্যমে বলেন,
“সরকারের সিদ্ধান্তে বা আইনগত কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। কিন্তু তাদের সমর্থকরা তো রয়ে গেছে। আমরা সেই সাধারণ ভোটারদের সমর্থন চাই, যাদের ওপর কোনো অপরাধের দাগ নেই।”

জামায়াতের মতে, বিএনপি তাদের ওপর অযথা ঐতিহাসিক দায় চাপিয়ে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে নস্যাৎ করতে চাইছে। তারা বলছে, ১৯৭১-এর প্রসঙ্গ টেনে বর্তমান রাজনীতি বিচার করলে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা ব্যাহত হবে।

ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বিএনপি কোনো মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে না; বরং দেশের মানুষকে অতীতের সত্য ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তার কথায়, “মানুষ জানে কোন সময়ে কোন দল কী ভূমিকা পালন করেছে। আমরা শুধু সেই ইতিহাস স্মরণ করাচ্ছি।”

পাল্টা যুক্তিতে জামায়াত বলছে, অতীত টেনে বর্তমানকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে। দুই দলের এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান নির্বাচনের মাঠে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

ত্রিমুখী ক্ষমতার লড়াই

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে তিনটি শক্তিকে সামনে দেখা যাচ্ছে—

  1. বিএনপি: ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্র সংস্কারের বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়।

  2. জামায়াতে ইসলামী: স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান পুনর্গঠন করতে চায়।

  3. আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট প্রভাব: দলটি নির্বাচনে না থাকলেও তাদের ভোটারগোষ্ঠী ও সাইবার কাঠামো রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয়।

এই তিন পক্ষের মেরুকরণ দেশের রাজনীতিতে এক নতুন দ্বন্দ্বের রেখা এঁকে দিয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দু ২০২৫ সালের জাতীয় নির্বাচন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি–জামায়াত সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই সুবিধাভোগী রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ক্ষমতার শূন্যতা, নির্বাচনী প্রতিযোগিতা এবং নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা পুরনো সেই সমীকরণকে ভেঙে দিয়েছে। দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, অভিযোগ–প্রত্যঅভিযোগ এবং ভোটব্যাঙ্ক খোঁজার প্রতিযোগিতা এখন পরিণত হয়েছে সরাসরি রাজনৈতিক লড়াইয়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলতে পারে এবং আসন্ন নির্বাচনে নতুন ধরনের রাজনৈতিক জোট ও মেরুকরণের জন্ম দিতে পারে।