বাংলাদেশের সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক নাম। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে তিনি দীর্ঘ সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাকে অনেকেই জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতৃত্ব হিসেবে বিবেচনা করেন।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাতীয় উদ্বেগ
৮১ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে ঢাকার বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ফুসফুসে সংক্রমণসহ একাধিক জটিলতায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড তার চিকিৎসা পরিচালনা করছে।
তার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকার প্রধানসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ তার সুস্থতা কামনায় দোয়া ও প্রার্থনা করছেন। মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডাসহ বিভিন্ন উপাসনালয়ে চলছে বিশেষ প্রার্থনা।
পাশে আছেন জোয়বায়দা রহমান ও শর্মিলা রহমান
অসুস্থ খালেদা জিয়ার অপেক্ষায় এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে আছেন নেতা কর্মী ও শুভাকাক্ষী। হাসপাতালে তার পাশে দুই পুত্রবধু ড: জোবায়দা রহমান শর্মিলা রহমান।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস প্রদান করেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর বরাতে জানা গেছে।
এদিকে চীন ও যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল ঢাকায় এসে তার চিকিৎসায় যোগ দিয়েছেন। প্রয়োজন হলে বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক পথচলা
১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮২ সালে তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে উঠে আসেন।
১৯৮৪ সালে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী কাউন্সিলগুলোতেও এ পদে পুনর্নির্বাচিত হন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হয় এবং শেষে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করলে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক রেকর্ড ও দায়িত্ব
খালেদা জিয়া দুইবার সার্কের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৩টি আসনেই জয়লাভ তার রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার অনন্য রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।
গ্রেফতার, মামলা ও প্রতিকূলতা
রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার গ্রেফতার ও মামলার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সময় এবং পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা হয়, যার মধ্যে কিছুতে তিনি খালাস পান এবং কিছু মামলায় তাকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়।
চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলেও তিনি বারবার বলেছেন—
“দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই।”
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, খালেদা জিয়া দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রতীক। তিনি বলেন,
“বেগম খালেদা জিয়া দেশ ও জনগণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। তার উপস্থিতি আজও দেশের গণতন্ত্রের জন্য অনুপ্রেরণা।”