বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনিশ্চয়তার ঘন কুয়াশা নেমে এসেছে। দেশের সাধারণ মানুষ এখন পরিস্থিতির দিকনির্দেশনা বুঝতে পারছে না। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বড় অংশেরই ধারণা—আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সহসা অনুষ্ঠিত নাও হতে পারে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতির কথা বললেও বাস্তব পরিস্থিতি, রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও বিভিন্ন গুঞ্জন জনগণের মনে দিন দিন সন্দেহ বাড়িয়ে তুলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছে। কমিশনও জানিয়েছে, আগামী ১১ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি—সম্ভাব্য ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থা মাঠে নেমে প্রস্তুতি শুরু করলেও, রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতা সাধারণ মানুষের মনে অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভুত হচ্ছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সেনাপ্রধানও সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এ নিশ্চয়তা বা আশ্বাসে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে কাটাতে যথেষ্ট হচ্ছে না। কারণ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি—বিশেষ করে নেতৃত্বসংক্রান্ত জটিলতা—নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের প্রশ্ন তৈরি করেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তার রাজনৈতিক ভূমিকা এখন কার্যত নিষ্ক্রিয়। অন্যদিকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে চলমান অনিশ্চয়তায় বিএনপির ভেতর-বাহিরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। একাধিকবার তার দেশে ফেরার সম্ভাব্য তারিখ জানানো হলেও, শেষ পর্যন্ত তিনি দেশে ফেরেননি। ফলে সাধারণ মানুষ তো বটেই, নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও মনে করছেন—তারেক রহমানের দেশে ফেরা আসলেই অনিশ্চিত। বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা বারবার আশ্বাস দিলেও ঘন ঘন তারিখ পরিবর্তন ও প্রতিশ্রুতি দিলেও তারেক রহমানের দেশে না ফেরার কারণে অনেকেরই বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে সাম্প্রতিক একটি স্ট্যাটাস পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে তৈরী করেছে। তার মন্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাদের ভাষায়, “বাংলার আকাশে যে কালো মেঘ দেখা দিয়েছে, তা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না।” বিএনপি ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মনে করছেন—ভবিষ্যতে যে পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা রাজনৈতিকভাবে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, দেশে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার পর এখন ‘মাইনাস ফোর’ ফর্মুলা নিয়ে দেশি-বিদেশি শক্তির গোপন তৎপরতা চলছে—এমন একটি গুজব সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এসব গুজবের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রমাণ নেই, তবুও জনমনে বিভ্রান্তি তৈরির জন্য এগুলো যথেষ্ট। রাজনৈতিক পরিবেশ কতটা উত্তপ্ত হতে পারে, তা নিয়ে সংশয় ও শঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে, শিল্প ও ব্যবসায়িক খাত স্থবির হয়ে পড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। কারণ ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, নির্বাচিত সরকার না থাকায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। মাঝারি ও বড় শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে এগোতে সাহস পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ী মহল বলছে—দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক স্থবিরতার মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে। তারা মনে করছে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোই শুধু নয়, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রশাসন—সকলেই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ দীর্ঘ ১৫ বছর পর যদি সত্যিকারের জনগণের ভোটে একটি নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়, তবে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হবে। সাধারণ মানুষের জীবনেও পরিবর্তন আসবে। তবে সরকার বারবার আশ্বস্ত করলেও জনগণের একটি বড় অংশ এখনো নিশ্চিত নন নির্বাচন সময়মতো হবে কি না। কারণ মাঠপর্যায়ে দেখা যাচ্ছে—চাপা উত্তেজনা, গুঞ্জন, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা বেড়েই চলেছে। অনেকেই মনে করছেন, “বাংলার আকাশে রাজনৈতিক দুর্যোগের গর্জন শোনা যাচ্ছে।” মানুষের মনে প্রশ্ন—এর শেষ কোথায়?
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ বলেছেন, তারেক রহমান অবশ্যই সঠিক সময় তার সুবিধামত দেশে ফিরবেন। নির্বাচন নিয়ে সাধারন মানুষ অনিশ্বয়তার কথা বললেও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বার বার জানিয়েছেন নিবার্চন সঠিক সময় অনুষ্ঠিত হবে।