ঢাকা, শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ০৭:৫০:৫১ PM

বিপ্লবী ওসমান হাদির জন্য কাঁদছে বাংলাদেশ

স্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
20-12-2025 05:50:21 PM
বিপ্লবী ওসমান হাদির জন্য কাঁদছে বাংলাদেশ

দেশের লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সমাহিত হয়েছেন জুলাই বিপ্লবী ও আধিপত্যবাদবিরোধী ‘ইনকিলাব মঞ্চ’র মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদি। শনিবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। এর আগে দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ওসমান হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা পড়ান তার বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। এতে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, অন্তর্র্বতী সরকারের একাধিক উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের জনতা। এছাড়াও ছিলেন শরিফ ওসমান হাদির পরিবারের সদস্য এবং তার সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যরা। 
জানাজার আগে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও হাদির ভাই আবু বকর সিদ্দিক। আবু বকর সিদ্দিক তার বক্তব্যে হাদির স্মৃতিচারণ করেন এবং তার জন্য দোয়া কামনা করেন।

এসময় সেখানে কান্নার রোল পড়ে যায়।
জানাজার আগে সংসদ ভবন প্লাজার সামনের মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। অনেকেই সংসদ ভবনের মাঠে প্রবেশ করতে না পেরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের রাস্তায় চোখে অশ্রু নিয়ে দাঁড়িয়ে হাদির জানাজায় অংশ নেন। জানাজার পর তার লাশ অ্যাম্বুলেন্সযোগে সমাধিস্থলে নিয়ে আসা হয়। জানাজায় তো বটেই হাদির দাফনের সময়ও মানুষ কেঁদেছেন। তাকে এক পলক দেখার জন্য কেঁদেছেন, কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। অনেকেই চোখের জল আড়াল করতে গিয়েও পারেননি। 

হাদির জানাজার সময় মানিক মিয়া এভিউনিউ যেন ছিল এদিন এক খণ্ড বাংলাদেশের চিত্র। জানাজায় ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমও কান্নায় ভেঙে পড়েন।

কান্নায় ভেঙে পড়েন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক (এনসিপি) নাহিদ ইসলাম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, উত্তরাঞ্চলের মুখ সংগঠক সারজিস আলম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতকর্মীদের কাঁদতে দেখা গেছে। কেঁদেছেন ব্যারিস্টার ফুয়াদসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
শুধু তাই নয়, হাদির মৃত্যুর পর থেকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরেও কান্নার রোল পড়ে যায়। বিভিন্ন বাসা বাড়ি থেকে মায়েরা রাস্তায় নামেন, কান্না করতে করতে হাদি হত্যার বিচার চান। ঘরে বসে থাকতে পারেননি বৃদ্ধরাও। কেউ কেউ তাদের সন্তানদের কাঁধে নিয়ে হাদি হত্যার বিচার চাইতে রাস্তায় নামেন। সবার মুখে একই কথা, আমাদের হাদি চাই। এক হাদি চলে গেছে, লাখো হাদির জন্ম হবে।

সামাজিক মাধ্যমেও হাদির জন্য ছড়িয়ে পড়েছে শোকগাঁথা। হাদিকে হারিয়ে কাঁদছে দেশের সবশ্রেণীর মানুষ। এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি তার সন্তানকে কাঁধে করতে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় হাটছেন। চিৎকার করে বলছেন, আমার হাদি চাই, এই বাংলাদেশ হাদিকে চায়। আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আমার বাংলাদেশের জন্য হাদিকে প্রয়োজন। 

আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, এক বৃদ্ধ নারী কোনো এক সংবাদ সম্মেলনে হাদিকে নিয়ে কথা বলার সময় কান্না করছেন। তিনিও হাদি হত্যার বিচার চাইছেন। হাদিকে যারা চেহারায় চেনেন না, না শুনেছেন। জেনেছেন হাদি গণঅভ্যুত্থানের অগ্র সেনানী, ভারতীয় আগ্রসনবিরোধী; তারাও কেঁদেছেন।

যে শাহবার একটা সময় ফ্যাসিস্টদের আস্তাবল ছিল, সেখানেও মানুষের কান্নার রোল পড়েছে। 

ওসমান হাদি ছিলেন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে জুমার নামাজের পর নির্বাচনী গণসংযোগের জন্য অটোরিকশাযোগে রাজধানীর বিজয় নগর এলাকায় যাওয়ার পথে দুর্বৃত্ত ফয়সাল করিম মাসুদের গুলিতে গুরুতর আহত হন।

এরপর টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা ওসমান হাদি পরে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ গড়ে তুলে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আলোচনায় আসেন।
বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতেও নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতে থাকেন তিনি। তার যুক্তিতর্কের অনেক ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। তিনি আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। 

গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাসখানেক আগে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ওসমান হাদি। তিনি গত নভেম্বরে নিজের ফেসবুক পেজে বলেছিলেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাকে ফোনকল করে এবং মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ ক্যাডাররা তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছে। তবে প্রাণনাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ইনসাফের লড়াই থেকে পিছিয়ে যাবেন না তিনি। ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোড এলাকায় প্রচারে যাওয়া ওসমান হাদিকে গুলি করে মোটরসাইকেলে আসা দুই সন্ত্রাসী। রিকশায় থাকা হাদি মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর তাকে নেওয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। অবস্থা গুরুতর দেখে সেখান থেকে হাদিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যায় সরকার। চিকিৎসকদের সর্বাত্মক চেষ্টার পরও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যান হাদি। বৃহস্পতিবার রাতে তার মৃত্যুর খবর জানান চিকিৎসকরা।

ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূল সন্দেহভাজন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সল করিম মাসুদ ও তার সহযোগী আলমগীর শেখ। তারা ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।

মৃত্যুর পর ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ওসমান হাদির লাশ বাংলাদেশে আনা হয়। সেখান থেকে লাশ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হিমঘরে নেওয়া হয়।

হাদির মৃতুতে আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা হচ্ছে। দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রয়েছে।