ঢাকা, রবিবার, ২ নভেম্বর ২০২৫,
সময়: ১২:২৬:৪৩ AM

কোন ধরনের সংস্কার? মৌলিক নাকি গুণগত?

শায়রুল কবির খান
01-11-2025 07:59:44 PM
কোন ধরনের সংস্কার? মৌলিক নাকি গুণগত?

সংস্কারের প্রশ্নটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্থায়ী ও জরুরি বিষয়। কিন্তু কোন ধরনের সংস্কার? মৌলিক নাকি গুণগত? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনবার মৌলিক সংস্কার হয়েছে। প্রথমটি ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম, দ্বিতীয়টি ১৯৭৫ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জাতিসত্তা ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠা, এবং তৃতীয়টি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অধীনে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এসব মৌলিক ভিত্তি স্থাপন হয়ে যাওয়ায় এখন নাগরিকদের মাঝে গুণগত পরিবর্তনের চাহিদা মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকে ছাপিয়ে গেছে। এখন নাগরিকদের মাঝে মৌলিক সংস্কারের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সংঘটিত ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন বাঁক। এই অভ্যুত্থানের পর জনগণের প্রধান দাবি ছিল ‘গুণগত পরিবর্তন’, অর্থাৎ সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসেও যখন ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয় এবং দীর্ঘ ধারাবাহিক বৈঠকের মাধ্যমে ১৭ অক্টোবর ২০২৫ সালে ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়, তখন প্রশ্ন জাগে: আমাদের এই আকাঙ্ক্ষিত সংস্কারের ভিত্তি কি আদৌ মজবুত?

সংস্কার কর্মযজ্ঞ বৈঠক, আলোচনা আর নাগরিক সমাজে কথোপকথনও। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রে উত্তরণের যে যজ্ঞ এখনও চলমান, তা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্কার-সংলাপ কথিত জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে কতখানি সফলতা পেয়েছে বা পাবে এ প্রশ্ন আমাদের ইতিহাসের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

রাজনীতির ইতিহাসে ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের আগে ১/১১-এর সময়ও সংস্কার-সংলাপের মুখোমুখি হয়েছিল দেশ তখন সফলতা পায়নি।

এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘ঐকমত্য কমিশন’। ইতোমধ্যে কমিশনটি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছিলেন।

১৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টায় বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টা এবং কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বৈঠক। এতে অংশ নেয় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন দল ও জোট।

পরবর্তী পর্যায়ে ১৮ মার্চ জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে প্রথম বৈঠক হয় এলডিপির সঙ্গে। এলডিপি চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ২০০১-০৬ বিএনপি সরকারের সময় সংসদ-সদস্য এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন, ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পরে দল গঠন করেন। ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের মহাজোটে অংশ নেন।

২০১৭ সালের ১০ মে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ’২০-৩০ ভিশন’ রূপকল্প তুলে ধরেন দলীয় চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এরপর ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফার রাষ্ট্র সংস্কার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। বর্তমানে ‘৩১ দফা’র ওপর ভিত্তি করে সারা দেশে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পাশাপাশি যুগপৎ ধারায় আন্দোলনরত রাজনৈতিক শক্তিগুলোও স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ৩১ দফাভিত্তিক সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে।

বিএনপি বর্তমানে রাজনৈতিক সংস্কারের অন্যতম নৈতিক ধারক ও বাহক হিসাব সক্রিয়। যদি ঐকমত্য কমিশন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর ১৯ দফা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া’র ২০-৩০ ভিশন ও জনাব তারেক রহমান-এর ঘোষিত ঐতিহাসিক ’৩১-দফাকে’ ন্যূনতম ভিত্তি ধরতেন তাহলে দেশ ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিতভাবে সম্ভব হতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করলেও, একটি বড় অংশের বিশ্বাস, কমিশনের নিজস্ব লক্ষ্যই শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য পেয়েছে।

কিন্তু, ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, সংস্কারের নামে আলোচনা ও সংলাপের উদ্যোগ অতীতেও নেওয়া হয়েছে, যেমন ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। তখনও সংলাপ শুরু হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি। রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে অবিশ্বাস, একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত ও গোপন এজেন্ডা সংলাপকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছিল।

২০০৮ সালের ২২ মে ওয়ার্কার্স পার্টি ও বিকল্প ধারার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করেছিল ১/১১ সরকার। ওই সংলাপ সফল হবে না ব্যর্থ হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলেই ছিল জল্পনা-কল্পনা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ব্যর্থতার দিকটি আলোচ্য ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য ও সংলাপের পরিকল্পনা ও বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাই করা হয়েছিল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা কম এবং সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভিন্নমতের পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। ১/১১ সরকারের সময় রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি যে বৈরিতা পরিলক্ষিত হয়েছে, তা একটি ষড়যন্ত্রের অংশ বলে অনেকেই মনে করেছিলেন।

সরকারবিরোধী রাজনীতিকরা সরকারের কথা বিশ্বাস করতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। অভিযোগ ছিল, সরকার এক অংশের রাজনীতি দমন করেছে, অন্যদিকে জনবিচ্ছিন্ন ও দুর্নীতিপরায়ণ অংশকে রক্ষা করেছে।

এ নিবন্ধের লেখকের ২০০৮ সালের ৫ জুলাই দৈনিক দিনকালে ‘সংলাপ নিয়ে সংক্ষিপ্ত লেখা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, যা ছিল তখনকার ১/১১ সরকারের সময়ে মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিন প্রশাসনের প্রেক্ষাপটে লেখা। সে লেখার একটি অংশে উল্লেখ ছিল, ‘সংলাপের সফলতা নির্ভর করছে নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। সরকার ও রাজনৈতিক দল কেউই একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। জনগণের চাহিদাভিত্তিক সংলাপ সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে সরকার সহজ ও গ্রহণযোগ্য পথ অবলম্বনের চেষ্টা করতে পারে।’

ওই লেখায় বলা হয়েছিল, ‘সংলাপ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে দুটি বিষয় বলা যায়: ১. সরকার যদি রাজনৈতিক দলের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারে, তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করার দিকেই যাবে। ২. সরকারের স্বার্থ বিবেচনায় একটি রোডম্যাপ অনুসরণ করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায় নিতে পারে।’

সেই ১/১১-এর সময়কার রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তবতা থেকে কতখানি সামনে এগিয়েছে বাংলাদেশ? বিশেষত রক্তস্নাত ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সামগ্রিক উদ্যোগে?

এমন পরিস্থিতিতে তাই প্রশ্ন তোলাই যায় যে, নাগরিকদের নিজের উপলব্ধি ছাড়া শুধু কাগুজে লেখার মধ্য দিয়ে সংস্কার রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব?

এই নিবন্ধনের লেখক ‘সংলাপ-সংস্কারে টানাপোড়েন’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ২৬ এপ্রিল প্রকাশিত লেখায় আগাম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ঐক্যমত্য কমিশন সংস্কার পরিণতির। যা আজ ৩০ অক্টোবর ২০২৫ বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টতই বলেছেন। মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্যের একটি অংশ উল্লেখ না করেই পারছি না। তিনি বলেছেন, ‘দীর্ঘ ১ বছর ধরে সংস্কার ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা অর্থহীন, প্রহসনমূলক এবং জাতির সাথে প্রতারণার শামিল ছিল।’

‘আমরা আন্তরিকভাবেই চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সাফল্য কামনা করি কিন্তু একটি দ্বায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের অবস্থান গ্রহণ ও প্রকাশে আমরা দ্বায়বদ্ধ।’

প্রশ্ন হলো, সংস্কার প্রক্রিয়া কতটা অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ? বিএনপির ৩১ দফাসহ বিভিন্ন দলের রূপকল্প ও পরিকল্পনাকে যদি ন্যূনতম ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা না করা হয়, তবে এই সংস্কার কতটা প্রতিনিধিত্বশীল? অতীতের মতই কি এটি হয়ে থাকবে শীর্ষস্তরের কিছু আলোচনা, যার ফলাফল সাধারণ মানুষের জীবনে কোনও পরিবর্তন আনবে না?

সংস্কার কেবল আলোচনা বা সনদ স্বাক্ষরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এর সাফল্য নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা, স্বচ্ছতা এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের ওপর। নতুবা, এটি হয়ে থাকবে কাগুজে অনুশীলন, যা দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের জন্য টেকসই ফল বয়ে আনবে না।

লেখক: শায়রুল কবির খান- রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী