বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই বড় দলগুলোর আধিপত্য স্পষ্ট। বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে অবস্থান করছে। এর পরেই সংগঠন ও জনভিত্তির দিক থেকে শক্ত অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এই দুই দলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে দেশের সামগ্রিক রাজনীতি। তবে এই বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছে ছোট ও নতুন রাজনৈতিক দলগুলো, যাদের অনেকেই এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। এদিকে তুলনামূলকভাবে মাঝারি শক্তির দল জাতীয় পার্টিও অভ্যন্তরীণ বিভক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ও আনিচুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন অংশ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, যা দলটির রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে আওয়ামী লীগের আত্মগোপনে থাকা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে। দলটি ইতোমধ্যে ২৪৫টি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়া না গেলেও আগামী সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে টিকে থাকার লক্ষ্যেই এই প্রস্তুতি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বড় দলের জোটে বিলীন হচ্ছে ছোট দল রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি ও জামায়াতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জোট রাজনীতিতে ছোট দলগুলোর জন্য টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। বেশ কয়েকটি ছোট দল ইতোমধ্যে এই দুই বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। আবার কেউ কেউ দল বিলুপ্ত করে সরাসরি বিএনপি কিংবা জামায়াতে যোগ দিয়েছেন। এর ফলে রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে একের পর এক ছোট দলের নাম হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় আদর্শিক অবস্থান, সংস্কার কিংবা বিকল্প রাজনীতির কথা বলে আত্মপ্রকাশ করা অনেক দল এখন বড় দলের ছায়াতেই নিজেদের ভবিষ্যৎ খুঁজছে। এতে করে তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় ও সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নাছোড়বান্দা ছোট দলগুলোর দুশ্চিন্তা তবে সব ছোট দল বড় দলে মিশে যেতে রাজি নয়। কিছু দল নাছোড়বান্দার মতো নিজেদের আলাদা অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছে। তারা ভাবছে—জোটে না গিয়ে কীভাবে রাজনৈতিক মাঠে টিকে থাকা যায়, কীভাবে ভোটারদের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব। এই দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জোটের বাইরে থাকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, প্রার্থী দেওয়া এবং গণমাধ্যমে জায়গা পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। আবার জোটে গেলে নিজেদের সিদ্ধান্ত ও মতাদর্শের স্বাধীনতা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। ফলে তারা এক ধরনের দ্বিধার মধ্যে পড়েছেন। জোটে যেতে চেয়েও পারছে না অনেক দল রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে যে, কিছু ছোট দল জোটে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও বাস্তবে তারা সেই সুযোগ পাচ্ছে না। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন জোটে নতুন করে দল অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। একাধিক রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, জামায়াত ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দলকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, নতুন করে আর দল নেওয়ার সুযোগ নেই। এর পেছনে জোটের আকার বড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, আসন সমঝোতার জটিলতা এবং আদর্শিক সামঞ্জস্যের প্রশ্ন কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে করে যেসব দল জামায়াতের সঙ্গে জোটে যেতে আগ্রহী ছিল, তারা হতাশ হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ আবার বিকল্প হিসেবে বিএনপির দিকে তাকাচ্ছে। বিএনপির অবস্থানও অনাগ্রহপূর্ণ তবে বিএনপির ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি খুব ভিন্ন নয়। আলোচনা রয়েছে, কয়েকটি ছোট দল বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও বিএনপি তাদের বিষয়ে তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছে না। দলটির নীতিনির্ধারকদের ধারণা, অতিরিক্ত ছোট দল যুক্ত হলে জোট পরিচালনা ও নির্বাচনি কৌশল আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। বিএনপির একাধিক নেতা অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় জানিয়েছেন, দলটি এখন সাংগঠনিকভাবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে এবং নতুন করে জোট সম্প্রসারণের চেয়ে বিদ্যমান শক্তি ও জনসমর্থনকে কাজে লাগাতেই বেশি মনোযোগী। ফলে ছোট দলগুলো প্রত্যাশিত সাড়া পাচ্ছে না। ছোট দলগুলোর হতাশা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে ছোট রাজনৈতিক দলগুলো। জোটে যেতে না পারলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কঠিন, আবার জোটে গেলেও নিজেদের পরিচয় হারানোর ভয়—এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে তারা হতাশ হয়ে পড়ছে। কিছু দলের নেতারা মনে করছেন, বড় দলগুলোর জোট রাজনীতি আসলে ছোট দলগুলোকে ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত ছেঁটে ফেলার একটি প্রক্রিয়া। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, ছোট দলগুলো নিজেরাই শক্ত সংগঠন ও জনভিত্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে জোট রাজনীতির বাস্তবতা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোট রাজনীতি এখন আর সমান অংশীদারিত্বের জায়গা নয়। এটি মূলত বড় দলগুলোর কৌশলগত প্রয়োজন পূরণের একটি মাধ্যম। ছোট দলগুলো এখানে সহযোগী শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা সীমিত থাকে। তারা আরও বলছেন, ছোট দলগুলো যদি দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে চায়, তবে শুধু জোটের ওপর নির্ভর না করে নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কর্মসূচি, জনসংযোগ এবং সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। রাজনীতির বহুমাত্রিকতা হারানোর আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট দলগুলোর বিলুপ্তি বা দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে দেশের রাজনীতিতে বহুমাত্রিকতা কমে যাচ্ছে। বড় দলগুলোর আধিপত্য বাড়লে বিকল্প মত, নতুন চিন্তা এবং সংস্কারমূলক রাজনীতির জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়বে। এতে গণতন্ত্রের জন্যও একটি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। কারণ শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী ও বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক শক্তির উপস্থিতি অপরিহার্য। সামনে কী অপেক্ষা করছে সব মিলিয়ে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট রাজনীতির ছায়ায় ছোট দলগুলোর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। কেউ বড় দলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, কেউ হতাশ হয়ে পড়ছে, আবার কেউ নাছোড়ভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এই সংকট ততই প্রকট হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। শেষ পর্যন্ত ছোট দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় কোন পথে হাঁটে—সেটিই এখন দেখার বিষয়।