ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ১১:৩০:১০ PM

উপন্যাস:”নীল আলো”পর্ব – ৭

মান্নান মারুফ
26-12-2025 09:32:48 PM
উপন্যাস:”নীল আলো”পর্ব – ৭

(যেখানে সব জঞ্জাল কেটে গিয়ে দুজন একে অপরকে বেছে নেয়)

রাশেদ হাল ছাড়ার মানুষ ছিল না। আলো সেটা বুঝে গিয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু এবার ব্যাপারটা সীমা ছাড়িয়ে গেল।

এক সকালে ফ্যাক্টরিতে ঢুকেই আলো টের পেল—পরিবেশটা আলাদা। সহকর্মীদের চোখে চাপা কৌতূহল, লাইনম্যানের গলা অস্বাভাবিক রুক্ষ। কাজ শুরু করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তাকে অফিসে ডাকা হলো।

রাশেদ বসে ছিল। টেবিলের ওপর কিছু কাগজ।

— তোমার নামে অভিযোগ এসেছে। কাজের গাফিলতি, শৃঙ্খলা ভঙ্গ।

আলো চমকে গেল।
— কী অভিযোগ?

রাশেদ ঠান্ডা গলায় বলল,
— তুমি জানো।

আলো জানত—এটা মিথ্যা। কিন্তু চাকরি হারালে কী হবে, সেই ভয়টা বুকের ভেতর ছুরি হয়ে বিঁধল।

— আমি কিছু করিনি।

রাশেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
— তাহলে সমস্যা কোথায়?

আলো চোখ তুলে তাকাল।
— সমস্যা আপনার।

এই প্রথম সে এত স্পষ্টভাবে বলল।

রাশেদের চোখ শক্ত হলো।
— বেশি সাহস দেখাচ্ছ। মনে রেখো, এখানে আমি যা চাই, তাই হয়।

সেদিন আলো কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরল। মাকে কিছু বলল না। ভাইদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো—এই সংসারটা যদি ভেঙে পড়ে?

নীলকে ফোন করল।

— আমার চাকরিটা চলে যেতে পারে।

নীল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
— তাহলে আমরা অন্য রাস্তা দেখব।

— এত সহজ না।

— আমি বলিনি সহজ। বলেছি—একসাথে।

এই কথাটাই আলোকে শক্ত করল।


পরদিন ঘটনা আরও খারাপ হলো।

রাশেদ লোক পাঠাল। কথায় কথায় হুমকি।
— বেশি বাড়াবাড়ি করলে চাকরি তো যাবেই, বদনামও হবে।

আলো প্রথমবার সত্যিই ভয় পেল। সেদিন সে কাজে গেল না। কোচিংয়েও না। সারাদিন ঘরে বসে থাকল। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না—লড়বে, না সরে যাবে?

সন্ধ্যায় নীল হাজির হলো।

হঠাৎ।

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা নীলকে দেখে আলো ভেঙে পড়ল।

— আপনি কেন এলেন?

নীল শান্ত গলায় বলল,
— কারণ এবার আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।

আলো সব বলল। হুমকি, অপমান, ভয়। কথা বলতে বলতে কাঁদল।

নীল মন দিয়ে শুনল। তারপর ধীরে বলল,
— আলো, তুমি চাকরিটা ছাড়তেও পারো।

আলো তাকাল।
— তাহলে আমার পরিবার?

— আমি জানি। তাই বলছি—এটা তোমার সিদ্ধান্ত। আমি চাপ দেব না।

এই কথায় আলোর চোখে জল এলো।
— সবাই বলে কী করতে হবে। আপনি বলছেন—আমি কী চাই।

নীল মাথা নাড়ল।
— কারণ এটা তোমার জীবন।

সেই রাতে আলো ঘুমায়নি। ভাবল—চাকরি, পড়াশোনা, ভয়, রাশেদ, নীল—সব একসাথে।

ভোরে উঠে সে সিদ্ধান্ত নিল।


পরদিন আলো ফ্যাক্টরিতে গেল। সোজা অফিসে।

— আমি চাকরি ছাড়ছি।

লাইনম্যান অবাক। রাশেদ হাসল।
— ভেবেছিলামই।

আলো শান্ত গলায় বলল,
— আমি ভয়ে নয়। নিজের সম্মানের জন্য ছাড়ছি।

রাশেদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই দরজায় নীল।

ফ্যাক্টরির কর্তৃপক্ষের একজনের সাথে কথা বলে এসেছে সে। কাগজপত্র, প্রমাণ—সব।

— হুমকি দেওয়ার বিষয়টা জানানো হয়েছে। আপনার আচরণও।

রাশেদের মুখের রং বদলে গেল। এতদিন সে ভেবেছিল—আলো একা।

সে ভুল ভেবেছিল।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিষয়টা বড় হয়ে গেল। তদন্তের কথা উঠল। রাশেদ চুপসে গেল।

আলো বেরিয়ে এল। চাকরি নেই। কিন্তু মাথা উঁচু।

বাইরে দাঁড়িয়ে নীল বলল,
— ভয় লাগছে?

আলো গভীর নিঃশ্বাস নিল।
— একটু। কিন্তু হালকা লাগছে।

নীল বলল,
— আমি আছি।


এরপর শুরু হলো নতুন লড়াই।

আলো পুরো সময় পড়াশোনায় দিল। কোচিং, লাইব্রেরি, রাত জেগে পড়া। নীল নিজের কাজের পাশাপাশি টিউশনের ব্যবস্থা করল আলোর জন্য। টাকা জমানো শুরু করল।

এই সময়ে রাশেদ শেষ চেষ্টা করল। ফোন, হুমকি। নীল একদিন সরাসরি বলল,
— আর একটা কল করলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।

তারপর আর ফোন আসেনি।

মাস কয়েক পর আলোর পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল। ভালো ফল।

সে নীলকে ফোন করল। কাঁপা গলায় বলল,
— আমি পেরেছি।

নীল হাসল।
— আমরা পেরেছি।


এক সন্ধ্যায় তারা আবার সেই চায়ের দোকানে বসেছিল। অনেকদিন পর।

আলো বলল,
— জানেন, যদি আপনি না থাকতেন…

নীল থামাল।
— যদি তুমি সাহস না করতে…

দুজনেই হাসল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আলো ধীরে বলল,
— এত ঝামেলা, এত লড়াই… আপনি ক্লান্ত হননি?

নীল আলোর দিকে তাকাল।
— তোমাকে ছাড়া থাকার চিন্তাটাই বেশি ক্লান্তিকর।

এই প্রথম কথাটা এত স্পষ্ট হলো।

আলো চোখ নামাল। তারপর বলল,
— আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না।

নীল ধীরে হাত বাড়াল। এই প্রথম।
— আমিও না।

চারপাশে কেউ খেয়াল করল না। চায়ের দোকান, ভিড়, শহর—সব আগের মতোই। কিন্তু তাদের জীবনে একটা অধ্যায় শেষ হলো।

বাধা ছিল।
হুমকি ছিল।
ত্যাগ ছিল।

কিন্তু প্রেমটা পিছিয়ে যায়নি।

সব জঞ্জাল কেটে গিয়ে তারা একে অপরকে বেছে নিয়েছে—সচেতনভাবে, ভয়ে নয়।

এটা কোনো রূপকথার মিলন নয়।
এটা বাস্তব জীবনের—লড়াই করে পাওয়া মিলন।

আর তাই এটা টিকে যাবে।

গল্প শেষ হয়নি।
কিন্তু এবার তারা পাশাপাশি।             চলবে…