দীর্ঘ ১৭ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা দেশের রাজনীতিতে নতুন গতি ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গত ২৫ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন তিনি। তার প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে যেমন উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে, তেমনি আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জোটের হিসাব-নিকাশ ও নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ নিয়েও জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় ও সংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দেশে ফেরা দলটির জন্য শুধু সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির বিষয় নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিকভাবে বড় একটি প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দলীয় সূত্র জানায়, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারেক রহমান বগুড়া-৬ এবং ঢাকা-১৭ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
নির্বাচনের সময়সূচি ও জোটের বাস্তবতা
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময় খুবই সীমিত। এই পরিস্থিতিতে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠনের দিকে এগোচ্ছে—এমন খবরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে।
অনেকে মনে করছেন, জামায়াত-এনসিপি সম্ভাব্য জোট দেশের বিরোধী রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে। তবে এনসিপির ভেতরেই এই জোট নিয়ে মতভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দলটির সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। এছাড়া জামায়াতের সঙ্গে জোটের বিরোধিতা করে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তত ৩০ জন নেতা আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামকে একটি চিঠি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
নেতৃত্ব সংকট ও ভেতরের টানাপোড়েন
এনসিপির অভ্যন্তরীণ এই মতবিরোধ দলটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। একদিকে দলটি নিজেকে সংস্কারপন্থি ও নতুন ধারার রাজনীতির বাহক হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে, অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে জোটের সিদ্ধান্ত সেই অবস্থানের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ—তা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, “ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে অন্য দলগুলোর মতভিন্নতা দেখা গেছে। সেখানে সংস্কারের বিভিন্ন পয়েন্টে স্বাভাবিকভাবেই এনসিপি, জামায়াত এবং আরও কয়েকটি দল একমত হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার, নতুনভাবে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার—সেটাকেই নির্বাচনি রাজনীতিতে জোট বা সমঝোতার প্রধান বিবেচনা হিসেবে আমরা দেখছি।”
তারেক রহমান ও নাহিদ ইসলাম: দুই ধারার নেতৃত্ব
তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক কয়েকটি গণমাধ্যম তাকে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও উল্লেখ করেছে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি, দল পরিচালনার অভিজ্ঞতা এবং বিএনপির ওপর তার প্রভাব তাকে জাতীয় রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত করেছে।
অন্যদিকে, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা তরুণ নেতা নাহিদ ইসলাম নতুন প্রজন্মের কাছে একটি প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এদিকে জামায়াত-এনসিপি জোট বাস্তবায়িত হয়েছে, তবে নাহিদ ইসলাম সেই জোটের মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন বলে আলোচনা চলছে। এমনকি নির্বাচনের পর সংসদে বিরোধী দলীয় নেতৃত্বেও তার নাম আসতে পারে—এমন সম্ভাবনার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
বদলে যেতে পারে ভোটের সমীকরণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একদিকে তারেক রহমানের নেতৃত্বে শক্তিশালী বিএনপি, অন্যদিকে জামায়াত-এনসিপি জোটের সম্ভাব্য উত্থান—এই দুই ধারার রাজনীতি আসন্ন নির্বাচনে ভোটের সমীকরণ বদলে দিতে পারে। তবে জোট রাজনীতির সফলতা নির্ভর করবে দলগুলোর ভেতরের ঐক্য, প্রার্থী নির্বাচন এবং ভোটারদের আস্থা অর্জনের ওপর।
সব মিলিয়ে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন, এনসিপির জোট ভাবনা এবং নাহিদ ইসলামের নেতৃত্ব—এই তিনটি বিষয় মিলেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এক অধ্যায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আসন্ন নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, ততই এই সম্ভাবনা ও সমীকরণ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।