(যেখানে প্রেম পরীক্ষার সামনে দাঁড়ায়)
সবকিছু একসাথে ভেঙে পড়ে না। কখনো কখনো খুব ধীরে—প্রথমে একটা সন্দেহ, তারপর একটা নীরবতা, শেষে দূরত্ব।
আলো প্রথম লক্ষ করল ব্যাপারটা ফ্যাক্টরিতে।
একজন নতুন সুপারভাইজার এসেছে। নাম রাশেদ। বয়সে বেশি না, কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাসী, কাজে চটপটে। শুরুতে আলো বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। প্রতিদিনের মতো কাজ, চাপ, সময়ের হিসাব—সব আগের মতোই।
কিন্তু কয়েকদিন পর থেকেই রাশেদ আলোর দিকে আলাদা নজর দিতে শুরু করল।
— আজ অনেকক্ষণ ধরে কাজ করছ, বিশ্রাম নাও।
— রিপোর্টটা আমি দেখে দিচ্ছি।
— কোচিংয়ে পড়ছ শুনেছি, ভালো করছ।
কথাগুলো বাইরে থেকে স্বাভাবিক। তবু আলোর অস্বস্তি লাগত। কারণ এই বাড়তি খেয়ালটা সে চায়নি।
একদিন কাজ শেষে রাশেদ বলল,
— বাসস্টপ পর্যন্ত একসাথে যাব?
আলো সরাসরি না বলল।
— আমি হেঁটে যাই।
সেই রাতেই নীলকে ফোন করল আলো। সব খুলে বলল না, শুধু বলল,
— আজ মনটা ভালো নেই।
নীল জিজ্ঞেস করল,
— কী হয়েছে?
আলো থামল। তারপর বলল,
— পরে বলব।
এই “পরে” থেকেই শুরু হলো দূরত্ব।
কয়েকদিন পর নীল হঠাৎ এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনল—
— গাজীপুরে তোকে নাকি কেউ টপকাতে এসেছে!
নীল হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল।
— বাজে কথা।
কিন্তু মনে সন্দেহ ঢুকে গেল। সে আলোকে ফোন করল।
— আজ অফিস কেমন গেল?
— ঠিকই।
— নতুন কেউ এসেছে?
আলো একটু চমকাল।
— কেন?
— এমনি।
আলো বুঝে গেল—নীল কিছু শুনেছে। কিন্তু সে তখনই সব বলতে পারল না। ভয় পেল—নীল ভুল বুঝবে।
এই না-বলা কথাটাই বড় হয়ে উঠল।
রাশেদ এবার সরাসরি কথা বলল।
— আলো, আমি তোমাকে পছন্দ করি।
আলো স্পষ্ট বলল,
— আমার অন্য কারও সাথে কথা চলছে।
রাশেদ হাসল।
— কথা চললেই শেষ হয়ে যায় না।
এই কথায় আলো ভয় পেল। সেদিন রাতে সে নীলকে কল দিল। নীল ধরল।
— আপনি ঠিক আছেন?
আলোর গলা কাঁপছিল।
— নীল, একটা সমস্যা হয়েছে।
সবটা বলল সে। এক নিঃশ্বাসে। রাশেদের কথা, অফিসের চাপ, নিজের ভয়।
নীল চুপ করে শুনল। তারপর ধীরে বলল,
— আপনি একা নন।
এই কথাটা আলোর বুকটা হালকা করে দিল।
কিন্তু পরের দিনই ঘটনা ঘুরে গেল।
ফ্যাক্টরিতে রাশেদ ইচ্ছা করে আলোর কাজের ভুল ধরল। রিপোর্টে নাম কেটে দিল। লাইনম্যানের সামনে অপমান।
আলো চুপ করে সহ্য করল। চাকরি ছাড়ার সাহস নেই। বাড়ির দায়, মায়ের ওষুধ, ভাইদের পড়াশোনা—সব তার কাঁধে।
সেদিন সে নীলের ফোন ধরল না।
নীল বারবার কল করল। মেসেজ পাঠাল। কোনো উত্তর নেই।
রাত গভীর হলো। নীল অস্থির হয়ে পড়ল।
পরদিন আলো ফোন ধরল।
— কেন ধরেননি?
আলো ক্লান্ত গলায় বলল,
— আমার সবসময় কথা বলার শক্তি থাকে না।
নীল থমকে গেল।
— আমি চাপ দিচ্ছি?
— না। কিন্তু সবসময় শক্ত থাকতে থাকতে… কখনো কখনো কাউকে দূরে রাখতে ইচ্ছে করে।
এই কথায় নীল আঘাত পেল।
— তাহলে আমি দূরে থাকি?
আলো বুঝল, কথা ভুল দিকে যাচ্ছে।
— আমি তা বলিনি।
কিন্তু কথাটা তখন আর ঠিক করা গেল না।
কয়েকদিন তারা কম কথা বলল। নীল নিজেকে গুটিয়ে নিল। ভাবল—আলো যদি চায়, সে জোর করবে না।
অন্যদিকে আলো প্রতিদিন ভাঙতে লাগল। অফিসে চাপ, বাড়িতে দায়, আর নীলের নীরবতা।
এক সন্ধ্যায় রাশেদ আবার বলল,
— তুমি কষ্ট পাচ্ছ। আমি পাশে থাকতে পারি।
আলো তাকিয়ে বলল,
— আপনি না।
এই দৃঢ়তাটুকু তাকে শক্ত রাখল।
সেই রাতেই আলো আর থাকতে পারল না। নীলকে ফোন করল।
— আপনি কি সত্যিই দূরে চলে যাচ্ছেন?
নীল চুপ করে ছিল। তারপর বলল,
— আমি ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো…
— আমি শুধু ক্লান্ত ছিলাম, নীল। দূরে নয়।
নীল চোখ বন্ধ করল।
— আমি আপনাকে হারাতে ভয় পাই।
এই প্রথম সে নিজের ভয়টা বলল।
আলো কেঁদে ফেলল।
— আমিও।
পরদিন নীল গাজীপুর এলো। হঠাৎ। কোনো প্ল্যান ছাড়া। আলো অবাক।
— আপনি এলেন কেন?
নীল শান্ত গলায় বলল,
— কারণ কিছু লড়াই দূর থেকে জেতা যায় না।
তারা বসেছিল আগের সেই চায়ের দোকানে। কিন্তু এবার দুজনই জানত—এটা শুধু চা নয়, একটা সিদ্ধান্তের জায়গা।
নীল বলল,
— আপনার পথে বাধা আসবে। আমি জানি। আমাকেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
আলো তাকিয়ে রইল।
— আপনি পারবেন?
নীল দৃঢ় গলায় বলল,
— না পারলে আমি আমি থাকব না।
এই কথাটা কোনো নাটকীয়তা নয়। এটা ছিল প্রতিজ্ঞা।
আলো ধীরে বলল,
— আমি একা পারব না।
নীল তার দিকে তাকাল।
— একা থাকতেও হবে না।
তারা হাত ধরল না। তবু সেই মুহূর্তে তারা জানত—এই সম্পর্ক আর সহজ নয়, কিন্তু ভেঙে যাওয়ার মতো দুর্বলও নয়।
প্রেমটা এখন আর শুধু অনুভূতি নয়।
এটা দাঁড়িয়ে থাকার লড়াই।
সহ্য করার শক্তি।
আর একে অপরকে না ছাড়ার সিদ্ধান্ত।
বাধা এসেছে।
দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
কিন্তু তারা ভাঙেনি।
কারণ এখন তারা জানে—
কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবে না।
গল্প এখানেই আরও গভীরে যায়।
চলবে…