বাসটা ধীরে ধীরে ছুটছিল। জানালার কাঁচে ভেসে আসছিল সন্ধ্যার আলো, শহরের ক্লান্ত মুখগুলো। ঢাকা–সায়েদাবাদগামী বাস। ভেতরে গাদাগাদি মানুষ, তবু এক ধরনের নিস্তব্ধতা—যেন সবাই নিজের জীবনের ভার কাঁধে নিয়ে বসে আছে।
নীল জানালার পাশে বসে ছিল। বন্ধুর বাসায় উঠবে—ঢাকায় এসেই। কাল সকালেই আবার সরাইল যেতে হবে। জীবনে সে খুব বেশি কিছু চায় না, তবু ভেতরে এক অজানা শূন্যতা কাজ করছে। সেই শূন্যতার দিকেই তাকিয়ে ছিল সে, যখন পাশের সিটে এসে বসল একটি মেয়ে।
মেয়েটির নাম আলো।
প্রথমে চোখাচোখি হয়নি। বাস চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর আলো ব্যাগটা গুছাতে গিয়ে হালকা অস্বস্তিতে পড়ে। নীল স্বভাবসিদ্ধ ভদ্রতায় বলল,
— ব্যাগটা আমি ধরে দিই?
আলো একটু অবাক হয়ে তাকাল। তারপর মৃদু হাসি।
— ধন্যবাদ।
এই ধন্যবাদ থেকেই শুরু।
কথা বলতে বলতে জানা গেল—দুজনেই সায়েদাবাদে নামবে। আলো গাজীপুর যাবে, আর নীল যাবে বন্ধুর বাসায়। একই গন্তব্য, কিন্তু ভিন্ন জীবন।
নীল জিজ্ঞেস করল,
— আপনি কী করেন?
আলো একটু থেমে বলল,
— গার্মেন্টসে চাকরি করি। আবার পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছি।
এই “আবার”-টার ভেতরে লুকিয়ে ছিল অনেক না-বলা কথা।
বাস ছুটে চলেছে। জানালার বাইরে রাত নামছে, ভেতরে কথার আলো জ্বলছে। আলো বলতে শুরু করল নিজের জীবনের গল্প—কোনো অভিযোগ নেই, তবু প্রতিটি বাক্যে ছিল ক্লান্তি।
— আমার বাড়ি বাখেরগঞ্জের নিয়ামতির ভরপাশা গ্রামে। বাবা নেই। মা অসুস্থ। ছোট দুই ভাই। তাই কাজ করতে হয়।
নীল চুপ করে আলো’র কথা শুনছিল। জীবনে অনেক গল্প শুনেছে, কিন্তু এই গল্পটা আলাদা। খুব কাছের, খুব বাস্তব।
— সকাল পাঁচটায় উঠি। রান্না করি। ভাত, ডাল। দুপুরের খাবার সাথে নিয়ে যাই। সাতটার মধ্যে ফ্যাক্টরিতে পৌঁছাতে হয়। কখনো ঠিকমতো ঘুম হয় না। কাজ করতে করতে চোখ বুজে আসে… তখন লাইনম্যানের বকা।
আলো হাসল। কিন্তু সেই হাসিতে আনন্দ ছিল না। ছিল কষ্টের ছাপ।
— কাজ শেষ করে রাত নয়টায় বাসায় ফিরি। প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটা। তারপর আবার রান্না। খেতে খেতে কখন যে বারোটা বাজে টের পাই না। ভোরে আবার উঠতে হয়।
নীল জিজ্ঞেস করল,
— ঠিকমতো ঘুম হয়?
আলো মাথা নাড়ল।
— হয় না। কিন্তু অভ্যেস হয়ে গেছে।
এই “অভ্যেস”-টাই নীলকে সবচেয়ে কষ্ট দিল।
বাসের ভেতর হালকা ঝাঁকুনি। কেউ চা ডাকছে। কেউ ফোনে কথা বলছে। কিন্তু নীল আর আলো মাঝখানে যেন আলাদা এক পৃথিবী তৈরি হয়েছে।
নীল বলল,
— এত কষ্ট করেন, তবু পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন—এটা সহজ নয়।
আলো জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল,
— পড়াশোনা না করলে তো জীবন বদলাবে না। আমি আমার মতো থাকতে চাই না সবসময়।
নীল মুগ্ধ হলো। এই মেয়েটার চোখে স্বপ্ন আছে—ক্লান্তির আড়ালে লুকোনো।
— আমার বাড়িও বাখেরগঞ্জেই, বলল নীল। — পাদ্রিশিবপুরের রঘুনাথপুর।
আলো অবাক হয়ে তাকাল।
— সত্যি? তাহলে তো আমরা একই জেলার।
এই “আমরা” শব্দটা অদ্ভুতভাবে দুজনকেই ছুঁয়ে গেল।
বাস সায়েদাবাদের দিকে এগোচ্ছে। সময় কেমন করে কেটে গেছে কেউ টের পায়নি। পরিচয়টা যে এত দ্রুত কাছের হয়ে উঠবে, দুজনের কেউই ভাবেনি।
নীল মনে মনে ভাবল—এই কয়েক ঘণ্টার যাত্রা হয়তো জীবনের অনেক দিনের শূন্যতা ছুঁয়ে গেল। আর আলো ভাবল—এই অচেনা মানুষটা কেন যেন নিরাপদ লাগছে।
বাস থামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আলো ব্যাগটা কাঁধে নিল।
— নামার সময় হয়ে গেছে।
নীল একটু থমকে বলল,
— আবার কি দেখা হবে?
আলো হালকা হাসল।
— জানি না। জীবন তো প্ল্যানমাফিক চলে না।
বাস থামল। সায়েদাবাদ।
দুজন নেমে দাঁড়াল, মানুষের ভিড়। আলাদা গন্তব্য, আলাদা পথ। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য দুজনই দাঁড়িয়ে রইল—যেন কিছু একটা বলা বাকি।
নীল বলল,
— ভালো থাকবেন, আলো।
আলো বলল,
— আপনিও, নীল।
ভিড়ের মধ্যে তারা হারিয়ে গেল।
কিন্তু বাসযাত্রাটা থেকে গেল—দুজনের ভেতরে, নীরব, আবেগে ভরা এক পরিচয় হয়ে।
চলবে…