ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ১১:০০:২২ PM

উপন্যাস:”নীল আলো”তৃতীয় পর্ব

মান্নান মারুফ
26-12-2025 08:33:54 PM
উপন্যাস:”নীল আলো”তৃতীয় পর্ব

কোচিং সেন্টারের ভেতরে ঢুকে দুজন আলাদা লাইনে দাঁড়াল। ফর্ম, টাকা, স্বাক্ষর—সব কাজই চলছিল স্বাভাবিক গতিতে। তবু দুজনের মন যেন বারবার একই জায়গায় ফিরে যাচ্ছিল—এই হঠাৎ দেখা। নীল মাঝেমধ্যে পাশ ফিরে তাকাচ্ছিল। আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। আগের মতোই সাদামাটা পোশাক, কাঁধে ব্যাগ, চোখে সেই চেনা ক্লান্তি। কিন্তু এবার ক্লান্তির ভেতরে একটু অন্যরকম দৃঢ়তা ছিল—যেন সে নিজের জায়গাটা ঠিক জানে।

ফর্ম জমা দেওয়া শেষ হলে বাইরে বেরিয়ে এল দুজন। বিকেলের রোদটা নরম হয়ে এসেছে। রাস্তার ধারে চায়ের দোকান, মানুষের ভিড়, বাসের হর্ন—সব মিলিয়ে গাজীপুরের চিরচেনা দৃশ্য।

নীল একটু ইতস্তত করে বলল,
— চা খাবেন? সময় থাকলে।

আলো এক মুহূর্ত ভেবে মাথা নাড়ল।
— একটু সময় আছে। সাতটার আগে ফ্যাক্টরিতে ঢুকতে হবে।

চায়ের দোকানে বসে দুজন চুপচাপ চা খেল। প্রথম কয়েক মিনিট কোনো কথা হলো না। নীরবতাটা অস্বস্তিকর নয়, বরং পরিচিত—যেমন বাসের সেই যাত্রায় ছিল।

নীল বলল,
— পড়াশোনা আবার শুরু করলেন, ভালো লাগল।

আলো কাপটা নামিয়ে বলল,
— থামালে আর শুরু করা যায় না। থামলেই সব শেষ।

এই কথায় কোনো অভিযোগ ছিল না। ছিল বাস্তবতা।

— ফ্যাক্টরির কাজ কেমন চলছে? জিজ্ঞেস করল নীল।

আলো একটু হাসল।
— আগের মতোই। কাজ বাড়ে, চাপ বাড়ে। কিন্তু মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায়। না হলে চলবে কী করে?

নীল কিছু বলল না। তার মনে হলো, আলো যেভাবে কথাগুলো বলছে, সেখানে কষ্ট আছে—কিন্তু নিজেকে দুর্বল দেখানোর কোনো চেষ্টা নেই।

চা শেষ হলো। আলো উঠে দাঁড়াল।
— আমাকে যেতে হবে।

নীল বলল,
— আমি একটু হাঁটব। আজ সরাইল যাব কাল সকালে।

একসাথে কিছুদূর হাঁটল তারা। কথা কম, ভাবনা বেশি। একটা মোড়ে এসে আলো থামল।

— এখান থেকে আমি আলাদা যাব।

নীল মাথা নাড়ল।
— ঠিক আছে।

একটু থেমে আলো বলল,
— বাসের সেই দিনটা… ভালো ছিল।

নীল হালকা হাসল।
— আমারও তাই মনে হয়।

আলো আর কিছু বলল না। ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। নীল দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল।


এরপর দিনগুলো আবার নিজের গতিতে চলতে লাগল।

আলো সকালে ফ্যাক্টরি, রাতে পড়াশোনা—এই দুইয়ের মাঝখানে জীবনকে ধরে রাখার চেষ্টা। কোচিংয়ে নতুন বন্ধু হলো। কেউ কেউ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— এত কাজ করে পড়াশোনা কীভাবে সামলান?

আলো শুধু বলে,
— দরকার আছে।

নীল সরাইলে ফিরে নিজের কাজে ডুবে গেল। ক্ষেতের কাজ, বাজার, গ্রামের লোকজন—সব আগের মতো। কিন্তু মাঝেমধ্যে গাজীপুরের কথা মনে পড়ে। কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আলোর মুখটা চোখে ভাসে।

কিছু সম্পর্ক কোনো নাম চায় না। তবু তারা থাকে।

মাসখানেক পর একদিন হঠাৎ আলো’র ফোনে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল এলো। কাজের মাঝখানে ধরতে পারেনি। রাতে ফিরে কল ব্যাক করল।

— হ্যালো?

ওপাশে একটু পরিচিত কণ্ঠ।
— আমি নীল।

আলো অবাক হলো।
— আমার নম্বর পেলেন কীভাবে?

— কোচিং সেন্টারে এক ছেলের কাছে ছিল। আপনার সাথে পড়ে।

আলো একটু হেসে বলল,
— আচ্ছা।

কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর নীল বলল,
— বিরক্ত করলাম?

— না। বলল আলো। — কথা বলতে ভালোই লাগছে।

সেই রাতে বেশি কথা হলো না। দুজনই ক্লান্ত ছিল। তবু কলটা কাটার পর আলো অনেকক্ষণ ফোনটা হাতে নিয়ে বসে ছিল।

পরের দিন আবার কল। তারপর আরেকদিন। কথা খুব সাধারণ—কাজ, পড়াশোনা, বাসের ভিড়, গ্রামের খবর। কোনো বড় স্বপ্নের কথা নয়, কোনো প্রতিশ্রুতি নয়।

একদিন আলো বলল,
— জানেন, আমার মা বলেন—মানুষের সাথে বেশি আশা করা ঠিক না।

নীল বলল,
— হয়তো ঠিকই বলেন।

আলো চুপ করে রইল।
— কিন্তু কেউ যদি পাশে থাকে, চুপচাপ—তাও তো খারাপ না।

নীল কিছু বলল না। শুধু শুনল।


একদিন রাতে ফ্যাক্টরি থেকে ফিরতে ফিরতে আলো হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। জ্বর, মাথা ঘোরা। ঘরে ফিরে মাকে শুইয়ে দিল, ভাইদের খেতে দিল। তারপর নিজে বিছানায় পড়ে রইল।

নীলকে ফোন দিল না। জানে, সবাই নিজের লড়াই নিয়ে ব্যস্ত।

কিন্তু পরদিন সকালে নীল নিজেই কল করল।
— কণ্ঠটা কেমন লাগছে আপনার?

আলো হালকা হেসে বলল,
— খুব ভালো না।

নীল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— আজ কাজ ছুটি নিতে পারলে নিন।

— নিলে বেতন কাটবে।

— শরীর থাকলে কাজ হবে, আলো।

এই প্রথম নীল তাকে নাম ধরে ডাকল জেনে-শুনে।

আলো আর কিছু বলল না। ফোনটা কাটার পর চোখ ভিজে এলো। কষ্টে নয়—এই অনুভূতির জন্য।


দিন যায়। জীবন বদলায় খুব ধীরে। কিন্তু বদলায়।

আলো পড়াশোনায় একটু একটু করে এগোয়। নীল নিজের কাজে স্থির হয়। তারা জানে না ভবিষ্যতে কী হবে। হয়তো একসাথে, হয়তো আলাদা পথে।

কিন্তু বাসের সেই যাত্রা, সায়েদাবাদের ভিড়, কোচিং সেন্টারের লাইন—সব মিলিয়ে একটা সত্য তারা দুজনেই বুঝে গেছে।

কিছু মানুষ হঠাৎ আসে।
থেকে যায়।
আর জীবনের ভার একটু হালকা করে দেয়।

গল্প এখানেই থামে না।
শুধু একটু বিরতি নেয়।

চলবে…