সায়েদাবাদের ভিড় ধীরে ধীরে দুজনকে আলাদা করে দিল। নীল হাঁটতে হাঁটতে কয়েকবার পেছনে তাকাল, কিন্তু আলোকে আর দেখা গেল না। অচেনা মানুষের ভিড়ে সবাই যেমন হারিয়ে যায়, আলোও তেমনই মিলিয়ে গেল।
বন্ধুর বাসায় পৌঁছে নীল ব্যাগটা নামাল। বন্ধু কথা বলছিল, চা দিল, দিনের গল্প করল—কিন্তু নীলের মন কোথাও আটকে ছিল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে ঢাকার রাত দেখছিল। হঠাৎ মনে হলো, বাসের সেই জানালার কাঁচটা যেন এখনো চোখের সামনে ভাসছে।
রাত গভীর হলে ফোনটা হাতে নিল নীল। কোনো নাম্বার নেই। তবু স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ—অকারণ। নিজেই একটু হাসল।
— কী বোকামি, বলল সে নিজেকে।
অন্যদিকে, গাজীপুরের ছোট ঘরটায় আলো ব্যাগটা নামিয়ে রাখল। মা ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাই দুটো পড়ার টেবিলে ঝিমোচ্ছে। আলো চুপচাপ রান্নাঘরে ঢুকে চুলা ধরাল। চাল ধোয়ার সময় হঠাৎ মনে পড়ল—
“ভালো থাকবেন, আলো।”
কেন যেন কথাটা অন্যরকম লাগল। অনেকেই তো বলে, কিন্তু এই কথাটায় কোনো তাড়া ছিল না, কোনো দাবি ছিল না। শুধু বলা।
পরদিন ভোর পাঁচটায় আলো উঠল। আগের দিনের মতোই। রান্না, বাস, ফ্যাক্টরি। মেশিনের শব্দ, লাইনম্যানের নির্দেশ, সময়ের চাপ—সব আগের মতো। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন মন দিয়ে তার কথা শুনেছিল—এই অনুভূতিটুকু তাকে অদ্ভুতভাবে হালকা রাখছিল।
নীল পরদিন সরাইলের বাসে উঠল। জানালার পাশে বসে। চারপাশে নতুন মুখ, নতুন গল্প। তবু সে অজান্তেই খেয়াল করল—পাশের সিটে কে বসছে।
কেউ বসেনি।
বাস ছাড়ল। জানালার বাইরে গ্রাম, মাঠ, আকাশ। নীল মনে মনে ভাবল—কিছু মানুষ জীবনে আসে, কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়াই, আবার চলে যায়। কিন্তু তারা থেকে যায় অনুভূতির কোনো এক কোণে।
সপ্তাহ কেটে গেল। মাসও।
একদিন বিকেলে গাজীপুরের এক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে গেল আলো। নাম লেখাতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে থাকা ছেলেটা হঠাৎ পেছনে তাকাল।
— আপনি কি… বাখেরগঞ্জের?
আলো একটু অবাক।
— হ্যাঁ। আপনি?
নীল মৃদু হাসল।
— পাদ্রিশিবপুর।
কয়েক সেকেন্ড দুজন চুপ করে রইল। শহরের কোলাহল, মানুষের আনাগোনা—সব যেন হঠাৎ নীরব হয়ে গেল।
আলো ধীরে বলল,
— আবার দেখা হয়ে গেল।
নীল মাথা নাড়ল।
— মনে হয়, কিছু যাত্রা এখানেই শেষ হয় না।
দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল। এবার আর বাস নয়—একই লাইনে, একই সময়ে।
জীবন যেমন হোক, গল্পটা আবার একটু এগিয়ে গেল।
চলবে…