ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ১১:০৩:৩৮ PM

উপন্যাস:”নীল আলো”পর্ব – ৫

মান্নান মারুফ
26-12-2025 09:04:56 PM
উপন্যাস:”নীল আলো”পর্ব – ৫

(যেখানে কাছাকাছি এসে দূরত্বটা বেশি টের পাওয়া যায়)

সব ঠিকই চলছিল—অথচ কিছু একটা ঠিক ছিল না। আলো নিজেও বুঝতে পারছিল না, ঠিক কবে থেকে নীলের একটা কল না এলে দিনটা অসম্পূর্ণ লাগে। আগে ফোনটা না বাজলেও সে নিজের কাজ চালিয়ে যেত। এখন ব্যস্ততার মাঝখানে হঠাৎ থেমে যায় মনটা—কেন জানি না।

সেদিন দুপুরে ফ্যাক্টরিতে অস্বাভাবিক চাপ ছিল। অতিরিক্ত কাজ, লাইনম্যানের চিৎকার, মাথার ভেতর ধোঁয়া। বিরতিতে আলো ফোনটা বের করল। কোনো মেসেজ নেই। নীল সাধারণত এই সময়ে একটা “খাওয়া হয়েছে?” পাঠায়।

আজ আসেনি।

আলো নিজেকে বোঝাতে চাইল—সবাই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু মনটা মানল না।

সন্ধ্যায় কোচিং শেষে বাড়ি ফিরেও ফোন এল না। আলো নিজেই কল দিতে গিয়েও থেমে গেল। অহেতুক মনে হলো—সব সময় তো সে-ই অপেক্ষা করছে। নীল কি কখনো টের পায়?

রাতে ফোন এল। কিন্তু সেটা নীল নয়—কাজের ফোন।

ঘুম আসছিল না। আলো বারবার ফোনের স্ক্রিন জ্বালাচ্ছিল। একটা সময় অভিমানটা স্পষ্ট হয়ে উঠল—কিছু না বলেও যে কষ্ট হয়, সেটা কাকে বোঝাবে?

পরদিন সকালেও নীল ফোন করল না।

আলো রেগে গেল। নিজের ওপরই।
— এমন তো না যে সে কিছু বলেছে, ভাবল সে। তবু এই অস্থিরতা কেন?

সন্ধ্যায় হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।

নীল।

আলো ধরল না।

ফোনটা থামল। আবার বেজে উঠল। এবার ধরল।

— হ্যালো। কণ্ঠটা ঠান্ডা।

নীল ওপাশে একটু থেমে বলল,
— ঠিক আছেন?

— আছি।

— কাল আর আজ ফোন করিনি… একটু সমস্যা ছিল।

— বুঝেছি।

এই “বুঝেছি”-র ভেতরে জমে থাকা অভিমানটা নীল বুঝল।
— রাগ করেছেন?

আলো চুপ করে রইল।

— আলো?

— না। রাগ করার কিছু নেই।

নীল দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
— বাবার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। হাসপাতালে ছিলাম।

এই কথা শুনে আলোর বুকটা কেঁপে উঠল।
— এখন কেমন আছেন উনি?

— একটু ভালো।

আলো নিজের অভিমানটার জন্য লজ্জা পেল।
— আপনি তো বললেন না…

— বললে আপনি চিন্তা করতেন।

এই কথাটায় আলোর চোখ ভিজে উঠল।
— আমি চিন্তা করলেও তো… আমি আছি।

নীল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর খুব নিচু গলায় বলল,
— জানি।

এই এক শব্দে সব অভিমান গলে গেল।


কয়েকদিন পর নীল আবার ঢাকায় এলো। এবার আগেভাগেই আলোকে জানাল।
— যদি সময় পান, দেখা করতে চাই।

আলো বলল,
— সময় বের করব।

সেদিন দেখা হলো আগের সেই চায়ের দোকানেই। কিন্তু এবার আলো একটু অন্যরকম। চোখে চাপা ক্লান্তি, মুখে কম কথা।

নীল বলল,
— আপনি ঠিক নেই।

— আছি।

— না।

আলো তাকাল।
— সবসময় শক্ত থাকতে থাকতে ক্লান্ত লাগে।

নীল প্রথমবার আলোর দিকে এমন করে তাকাল—যেন ভেঙে পড়লে সে ধরে ফেলবে।
— আপনি শক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন। এটা দোষ না।

আলো হালকা হাসল।
— আপনি জানেন, মানুষ কখন বেশি কষ্ট পায়?

— কখন?

— যখন সে কাউকে অভ্যেস করে ফেলে।

এই কথায় নীল চুপ করে গেল।

চা ঠান্ডা হয়ে এলো। চারপাশে ভিড়, অথচ তাদের চারপাশে যেন আলাদা এক নিস্তব্ধতা।

নীল ধীরে বলল,
— আমি যদি কোনোদিন… আপনার কষ্টের কারণ হয়ে যাই?

আলো তাকিয়ে রইল।
— তাহলে বলব। চুপ করে থাকব না।

নীল মাথা নাড়ল।
— আমিও তাই চাই।

এই প্রথম দুজনের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হলো—না বলা কথা জমে থাকতে দেবে না।


বিদায়ের সময় আলো হঠাৎ বলল,
— আপনি মাঝে মাঝে খুব দূরে থাকেন।

নীল থেমে গেল।
— ইচ্ছে করে না।

— জানি। তবু লাগে।

নীল কোনো অজুহাত দিল না।
— চেষ্টা করব।

এই “চেষ্টা করব”-টা প্রতিশ্রুতি নয়। কিন্তু আলো জানত—এই মানুষটা কথাটা হালকা করে বলে না।


সেই রাতেই নীল প্রথমবার নিজে থেকে মেসেজ পাঠাল,
“পৌঁছালেন?”

আলো তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের দিকে। খুব ছোট একটা প্রশ্ন। অথচ ভেতরে ঢেউ তুলল।

উত্তর দিল,
“হ্যাঁ। ধন্যবাদ।”

কিছুক্ষণ পর আরেকটা মেসেজ এল,
“আজ কথা বলে ভালো লেগেছে।”

আলো লিখল,
“আমারও।”

এই দুই শব্দের মাঝখানে আর কিছু লেখার দরকার পড়ল না।


প্রেমটা এখন আর শুধু নীরব নয়।
এতে অভিমান আছে।
আছে ভয়—হারানোর।
আছে রোমাঞ্চ—কাছাকাছি আসার।

তবু এখনো কেউ বলেনি—ভালোবাসি।

কারণ কিছু অনুভূতি উচ্চারণের আগেই গভীর হয়ে যায়।

গল্প এখানেও থামে না।
কারণ এখন তারা শুধু পাশে নয়—একটু একটু করে একে অপরের ভেতর ঢুকে পড়ছে।

চলবে…