ঢাকা, সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ০৯:১৫:৫৭ PM

মির্জা ফখরুল:ভদ্রতা, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রতীক

স্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
22-12-2025 07:15:58 PM
মির্জা ফখরুল:ভদ্রতা, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রতীক

মার্জিত ভাষা, ভদ্র আচরণ এবং সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি সুপরিচিত ও সম্মানিত নাম। তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি পারিবারিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে ব্যক্তিগত সততা, রাজনৈতিক শালীনতা ও দলীয় আনুগত্যের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতির কঠিন পথ অতিক্রম করে চলেছেন। জেল-জুলুম, মামলা ও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি কখনো দলের প্রতি বিশ্বাস ও দায়িত্বশীলতা থেকে বিচ্যুত হননি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ২৬ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও জেলার একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার পিতা মির্জা রুহুল আমিন ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। স্বাধীনতার আগে ও পরে তিনি একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার মাতা মির্জা ফাতেমা আমিন ছিলেন শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা ও পারিবারিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন নারী। এই রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশেই মির্জা ফখরুলের মানসিক গঠন ও নেতৃত্বের ভিত্তি তৈরি হয়।

শিক্ষাজীবনে তিনি ছিলেন মেধাবী ও মননশীল। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেন। তিনি ঢাকা কলেজে অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন।

শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। বাংলাদেশ সরকারের পরিদর্শন ও আয়-ব্যয় নিরীক্ষণ অধিদপ্তরে একজন নিরীক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী এস. এ. বারীর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। তবে ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করলে এস. এ. বারী পদত্যাগ করেন এবং মির্জা ফখরুল পুনরায় শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান। তিনি ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি এস এম হল শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক চেতনা তার রাজনৈতিক দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

১৯৮৬ সালে তিনি শিক্ষকতা পেশা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অব্যাহতি নিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৮ সালে ঠাকুরগাঁও পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন। ১৯৯২ সালে তিনি বিএনপির ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন এবং একই সঙ্গে কৃষক দলের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

সংসদীয় রাজনীতিতে তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালে। পঞ্চম ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তিনি পরাজিত হন। তবে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছর বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি প্রথমে কৃষি প্রতিমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঠাকুরগাঁও-১ ও বগুড়া-৬—দুটি আসন থেকেই বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান এবং বগুড়া-৬ আসনে নির্বাচিত হন। তবে শপথ গ্রহণ না করায় নির্বাচন কমিশন পরবর্তীতে ওই আসন শূন্য ঘোষণা করে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নিজ জেলা ঠাকুরগাঁও থেকে বিএনপির মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

দলীয় রাজনীতিতে মির্জা ফখরুলের গুরুত্ব আরও সুদৃঢ় হয় ২০০৯ সালে বিএনপির পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনে। তিনি দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব খন্দকার দেলওয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়া তাকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিযুক্ত করেন। ২০১৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির মহাসচিব নির্বাচিত হন।

বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তিনি বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, কর্মসূচি ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সরকারের নীতিনির্ধারণী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন দৃঢ় ও সোচ্চার সমালোচক। বহুবার গ্রেপ্তার, মামলা ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হলেও তিনি কখনো দলীয় আদর্শ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে সরে যাননি।

ব্যক্তিগত জীবনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাহাত আরা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তাদের দুই কন্যা রয়েছে, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। পারিবারিক জীবনেও তিনি সংযমী, শালীন ও শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে পরিচিত।

ভদ্রতা, মিতভাষিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সমন্বয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন গ্রহণযোগ্য ও আস্থাভাজন নেতা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি দলীয় আদর্শ ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান বজায় রেখে সমসাময়িক রাজনীতিতে নিজস্ব একটি মর্যাদার আসন তৈরি করেছেন।