পর্ব – ১১ পৃথিবীতে সবাই কারও না কারও আশ্রয়ে বড় হয়। কিন্তু আনিসা আর রতনের জীবনে সেই আশ্রয় শব্দটাই ছিল সবচেয়ে অচেনা। আনিসার মা–বাবা নেই, রতনেরও নেই। দুজনেই যেন জন্ম থেকেই ভাগ্যের কঠিন হাতে ছুঁয়ে গেছে। এই বিশাল পৃথিবীতে তারা দুজনই একা—ভিন্ন পথে হেঁটে, তবু একই শূন্যতা বয়ে নিয়ে।
রতন কখনো জানত না তার বাড়ি কোথায় ছিল, কার ঘরে তার জন্ম। তার স্মৃতির শুরু আর শেষ জুড়ে শুধু একটাই জায়গা—রেলস্টেশন। পাঁচ বছর বয়সে সে এই স্টেশনে এসে পড়েছিল, কিভাবে এসেছিল তা আজও তার মনে নেই। শুধু মনে আছে, এক বুড়ি মা তাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। সেই বুড়ি মা-ই ছিল তার পৃথিবী।
স্টেশনের এক কোণে ছেঁড়া কাপড়ের ছাউনির নিচে বুড়ি মা রতনকে মানুষ করেছিল। নিজে না খেয়ে ওকে খাইয়েছে, শীতে নিজের কাপড় খুলে ওকে ঢেকেছে। রতনের কাছে সে মা, বাবা, সবকিছু। কিন্তু সময় কারও জন্য থেমে থাকে না। রতনের বয়স যখন বারো, তখন এক শীতের রাতে বুড়ি মা আর জেগে ওঠেনি। ভোরবেলায় স্টেশনের কোলাহলের মাঝেই রতন বুঝে গিয়েছিল—সে আবার একা।
সেদিনের পর থেকে রতনের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। স্টেশনই তার বাড়ি, প্ল্যাটফর্মই তার বিছানা। ট্রেনের শব্দে সে ঘুমাত, ট্রেনের শব্দেই জাগত। কখনো কাজ পেলে করত, না পেলে অনাহারে থাকত। ভয় ছিল, কিন্তু কান্না ছিল না। কারণ কাঁদার মতো কেউ তখন আর তার পাশে ছিল না।
এই কঠিন জীবনের মাঝেই আনিসার সঙ্গে রতনের পরিচয়। ঠিক কবে, কীভাবে—সেটা কোনো গল্পের মতো নয়, বরং বাস্তবের মতোই সাধারণ। কিন্তু সেই সাধারণ ঘটনাই রতনের জীবনে অসাধারণ পরিবর্তন এনে দেয়। আনিসার চোখে সে প্রথমবারের মতো করুণা নয়, বিশ্বাস দেখেছিল। সেই দৃষ্টিটুকুই তাকে নতুন করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিল।
আনিসা রতনের জীবনে আলো হয়ে আসে। রতনও বুঝতে পারে, শুধু বেঁচে থাকলেই হয় না—ভরসা থাকলে বাঁচা সহজ হয়। আনিসার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই রতনের ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি জন্ম নেয়। সে আর আগের মতো ভেঙে পড়ত না। মনে হতো, কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার অস্তিত্বটা গুরুত্বপূর্ণ।
আনিসাও জানত না কেন সে রতনের পাশে থাকলে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। দুজনেই নিঃসঙ্গ, দুজনেই শেকড়হীন—হয়তো এই মিলটাই তাদের অজান্তেই কাছাকাছি এনে দিয়েছিল। তারা কেউ কাউকে কিছু বলেনি, তবু একে অপরের উপস্থিতি থেকেই সাহস পেত।
স্টেশনের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি আলো–আঁধারি তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। রাতের শেষ ট্রেন চলে গেলে, যখন প্ল্যাটফর্ম নিস্তব্ধ হয়ে যেত, তখনই যেন তাদের জীবনের আসল গল্পটা শোনা যেত—নীরব, কষ্টের, তবু আশায় ভরা।
এই পর্বে আনিসা আর রতনের গল্প এক নতুন মোড়ে দাঁড়ায়। দুজনেই বুঝতে শেখে—একাকিত্ব ভাগ করে নিলে তা আর ততটা ভয়ংকর থাকে না। সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা কেউ জানে না। কিন্তু এই স্টেশনের আলো–আঁধারির মাঝেই তারা খুঁজে পাচ্ছে বেঁচে থাকার নতুন অর্থ।
পর্ব – ১২
পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর। সে কাউকে সময় দেয় না, সুযোগও দেয় না প্রস্তুতির। সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে, যেন অন্ধকার নিজেই শহরের ওপর নেমে আসতে চাইছিল। দোকানের কাজ শেষ করে আনিসা বের হলো। সারাদিনের ক্লান্তি তার চোখে-মুখে জমে ছিল, তবু বুকে ছিল ছোট বোনটাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার তাড়া। বোনটি তার হাত শক্ত করে ধরে ছিল—নিরাপত্তার শেষ আশ্রয় যেন সেই হাতটাই।
রাস্তার আলো তখনও পুরো জ্বলেনি। অল্প আলো আর দীর্ঘ ছায়া মিলিয়ে চারপাশে এক ধরনের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ছিল। রাস্তায় লোকজন কম, দোকানপাটের শাটার নামতে শুরু করেছে। বাতাসে অদ্ভুত এক নীরবতা, যার ভেতর লুকিয়ে থাকে অজানা আশঙ্কা।
হঠাৎই আনিসা টের পেল—পেছনে কারও পায়ের শব্দ। প্রথমে সে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু শব্দগুলো যেন তার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিল। সে একটু দ্রুত হাঁটল। পায়ের শব্দও দ্রুত হলো। বুকের ভেতর অজানা ভয় জমে উঠল, তবু সে নিজেকে শক্ত রাখল। ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে সে সাহস জোগাল নিজেকে—ভয় পেলে চলবে না।
আনিসা চোখের কোণে দেখতে পেল কয়েকজন উঠতি যুবক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা তাকে লক্ষ্য করছে—এই অনুভূতিটাই তার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দিল। সে মাথা নিচু করে সামনে এগোতে থাকল, মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল—এই রাস্তা যেন দ্রুত শেষ হয়।
কিন্তু আশঙ্কা ভুল ছিল না। যুবকগুলো ধীরে ধীরে কাছে আসতে শুরু করল। কথা কম, চোখের ভাষা বেশি। চারপাশের নীরবতা যেন আরও ঘন হয়ে উঠল। আনিসার বুক ধড়ফড় করছিল, তবু সে দৌড়ায়নি। সে জানত, ভয় দেখালে বিপদ বাড়ে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তারা একেবারে কাছে চলে এলো। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল আনিসাকে। পথ বন্ধ, পালানোর জায়গা নেই। ছোট বোনটি আঁকড়ে ধরল আনিসার হাত, কাঁপতে লাগল। সেই কাঁপুনি যেন আনিসার বুকের ভেতর গেঁথে গেল।
হঠাৎই আনিসা একটি ফাঁক দেখতে পেল। ভয়কে উপেক্ষা করে সে দৌড় দিল। সবকিছু যেন একসাথে ঘটতে লাগল। পা হড়কে গেল, ভারসাম্য হারাল। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। ছোট বোনের হাত তার হাত থেকে ছিটকে গেল—এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গেল বলে মনে হলো।
একটি তীব্র শব্দ, চারপাশে হইচই। মানুষ ছুটে এলো। কেউ চিৎকার করল, কেউ থমকে দাঁড়াল। রাস্তার আলো জ্বলে উঠতেই দৃশ্যটা পরিষ্কার হলো। আনিসা আর উঠে দাঁড়াল না। ছোট বোনটিও নিথর হয়ে পড়ে রইল। সেই মুহূর্তে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানের রেখাটা ভয়াবহভাবে স্পষ্ট হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর পুলিশ এলো, লোকজন ভিড় করল। কেউ ফিসফিস করল, কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শহরের রাত আবার নিজের ছন্দে ফিরতে লাগল। কিন্তু দুটি ছোট জীবন সেখানে থেমে গেল—নিঃশব্দে, নিষ্ঠুরভাবে।
খবরটা পৌঁছাতে দেরি হলো না। রতন যখন শুনল, তার বুকের ভেতরটা যেন ফেটে গেল। সে দৌড়ে এলো, ছুটে এলো স্টেশন থেকে সেই রাস্তায়। কিন্তু এসে দেখল—সব শেষ। আনিসার মুখটা শান্ত, যেন গভীর ঘুমে। অথচ সেই ঘুম আর ভাঙার নয়।
রতনের চোখে পানি ছিল না। সে কাঁদতে পারেনি। চারপাশের শব্দ, আলো, মানুষের মুখ—সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। তার জীবনের একমাত্র ভরসার জায়গাটা মুহূর্তে শূন্য হয়ে গেল।
সেই রাতে শহর ঘুমিয়েছিল। ট্রেন চলেছে, বাতি জ্বলেছে, জীবন এগিয়েছে। শুধু রতনের জীবনটা থেমে গিয়েছিল সেখানে—এক নিষ্ঠুর সন্ধ্যার ছায়ায়।