ঢাকা, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ১১:৫৯:৪০ PM

অদৃশ্য খুনি ধুলো ও দূষণে বিপর্যস্ত ঢাকাবাসী

স্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
13-12-2025 09:26:17 PM
অদৃশ্য খুনি ধুলো ও দূষণে  বিপর্যস্ত ঢাকাবাসী

 ঢাকার বাতাসে ছড়িয়ে পড়া অদৃশ্য খুনি ধুলো ও ভয়াবহ বায়ুদূষণ এখন নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাতাসে সূক্ষ্ম কণার ঘনত্ব প্রতিনিয়ত বাড়ছে, যার মধ্যে শ্বাসযোগ্য সিলিকা ধুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই ধুলো সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।সম্প্রতি পরিচালিত দুটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় উঠে এসেছে, রাজধানীর বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণা (PM), ক্ষতিকর গ্যাস এবং শ্বাসযোগ্য সিলিকা ধুলোর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্ধারিত নিরাপদ সীমার বহু গুণ বেশি। গবেষণাগুলো ২০২৫ সালের শুরুতে পরিচালিত হয় এবং ঢাকার বায়ুদূষণের উৎস, মাত্রা ও মানবস্বাস্থ্যের ঝুঁকি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় রাজধানীর গাবতলী–আমিনবাজার, যাত্রাবাড়ী–ডেমরা, উত্তরা–আব্দুল্লাহপুর, কাঁচপুর–সোনারগাঁও, মুগদা–বাড্ডা—সহ মোট সাতটি করিডোরকে বায়ুদূষণের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় শ্বাসযোগ্য সিলিকা ধুলোর মাত্রা নিরাপদ সীমার তিন থেকে বারো গুণ পর্যন্ত বেশি পাওয়া গেছে।

শীতকালে দূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ

গবেষণায় বলা হয়েছে, শীতকালে ঢাকার বাতাস সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়। এ সময় বাতাস স্থির থাকে, আর্দ্রতা কমে যায় এবং সূক্ষ্ম কণার ঘনত্ব হঠাৎ বেড়ে যায়। বাতাসে ধুলো, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও ওজোনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। ফলে ঢাকার বায়ুদূষণ এখন আর মৌসুমি সমস্যা নয়, বরং সারা বছরের জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে।

দূষণের প্রধান উৎস

গবেষকরা জানিয়েছেন, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হলো রাস্তার ধুলো ও নির্মাণসামগ্রীর উন্মুক্ত স্তূপ। ভাঙাচোরা সড়ক, যানবাহন চলাচল এবং মানুষের পদচারণায় জমে থাকা ধুলো বাতাসে উড়ে বেড়ায়। ত্রিপল ছাড়া বালু পরিবহন, রাস্তার ওপর সিমেন্ট ও বালুর স্তূপ, নির্মাণস্থলে ইটভাঙা এবং সড়কে জমে থাকা ধুলো সিলিকার ঘনত্ব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

দ্বিতীয় প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যানবাহন ও শিল্পকারখানাকে। পুরোনো ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বিশেষ করে ডিজেলচালিত বাস ও ট্রাক, সূক্ষ্ম কণার মাত্রা বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি ছোট শিল্পকারখানা, বায়োমাস ও আবর্জনা পোড়ানোর ধোঁয়া ঢাকার বাতাসকে আরও দূষিত করছে। রাজধানীর দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পকারখানার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় সেখানে বাতাসের মান সবচেয়ে খারাপ।

ইটভাটাও বড় দূষণ উৎস

গবেষণায় বলা হয়েছে, ইটভাটা ঢাকার বায়ুদূষণের একটি স্থায়ী উৎস। সাভার–আশুলিয়া, ডেমরা–রূপগঞ্জ ও আমিনবাজার–গাবতলী এলাকায় কয়লাচালিত ইটভাটার ধোঁয়া দীর্ঘ সময় বাতাসে ঝুলে থাকে। পুরোনো প্রযুক্তির ইটভাটায় পর্যাপ্ত ফিল্টার ব্যবস্থা না থাকায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। গবেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়া দূষণ কমানো সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দূষণ শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, হৃদ্‌রোগ এবং জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। চোখের প্রদাহ, ত্বকের সমস্যা ও অ্যালার্জির প্রকোপও বৃদ্ধি পেয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসযোগ্য সিলিকা ধুলো ফুসফুসে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে, যা ‘সিলিকোসিস’ নামে পরিচিত এবং এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়।

পরিবেশের ওপরও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। গাছের পাতায় ধুলো জমে খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, গাছের বৃদ্ধি কমছে এবং ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। নদীর পানি অ্যাসিডিক হয়ে জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।

ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা

গাবতলী এলাকার বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, “রাস্তার ধুলো এত বেশি যে হাঁটতে গেলেই শ্বাসকষ্ট হয়। ছোটদের স্কুলে পাঠানোও ভয়ঙ্কর মনে হয়।”
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মরিয়ম বলেন, “নির্মাণকাজের ধুলো আর যানবাহনের ধোঁয়া মিলিয়ে বাইরে বের হওয়াই কঠিন। বারবার কাশি ও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।”

নীতিগত ব্যর্থতার অভিযোগ

গবেষকরা বলছেন, নীতিগত ব্যর্থতাই সমস্যার মূল কারণ। পরিবেশ আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। নির্মাণসামগ্রী খোলা রাখার নিষেধাজ্ঞা মানা হচ্ছে না, ইটভাটার নীতিমালা কার্যকর নয়, যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা নিয়মিত হয় না এবং বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও প্রকট।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘরের সঠিক ভেন্টিলেশন নিশ্চিত করা, ঘর পরিষ্কার রাখা এবং বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি। একই সঙ্গে সরকারকে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

তিনি বলেন, “ফিটনেসবিহীন যানবাহন কোনোভাবেই রাস্তায় চলতে দেওয়া উচিত নয়। নির্মাণক্ষেত্রে পরিবেশসম্মত সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। শুধু সচেতনতা নয়, আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।”

জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, ইটভাটাকে আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর, পুরোনো যানবাহন ধাপে ধাপে বন্ধ, সড়কে নিয়মিত পানি ছিটানো, পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং জোরদার এবং নগরজুড়ে সবুজায়ন বাড়ানো ছাড়া ঢাকার বাতাস শ্বাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এর প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি ও ভয়াবহ।