ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ১১:০১:৩৭ PM

উপন্যাস:”নীল আলো”পর্ব – ৪

মান্নান মারুফ
26-12-2025 08:48:35 PM
উপন্যাস:”নীল আলো”পর্ব – ৪

(যেখানে না-বলা কথাগুলোই সবচেয়ে বেশি কথা বলে)

দিনগুলো কেমন যেন বদলে যেতে লাগল, কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই। আলো এখনো ভোর পাঁচটায় ওঠে, নীল এখনো নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। তবু দুজনের দিনের ভেতরে অদ্ভুত একটা জায়গা তৈরি হলো—যেখানে একজন আরেকজনের খোঁজ রাখে, নিঃশব্দে।

আলো সকালে বাসে উঠলে ফোনটা একবার দেখে নেয়। কোনো মেসেজ এসেছে কি না—এই প্রশ্নটা এখন আর অকারণ মনে হয় না। অনেক সময় কিছু থাকে না। তবু দেখাটা অভ্যাস হয়ে গেছে।

নীলও তেমনই। রাতে কাজ শেষ করে ফোনটা হাতে নিলে প্রথমেই আলোর নামটা চোখে পড়ে। সে নিজেই অবাক হয়—কখন এই নামটা এত পরিচিত হয়ে গেল?

কথা খুব বেশি হয় না। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই হয়।

— আজ ফ্যাক্টরিতে চাপ কেমন?
— খুব বেশি।
— খেয়াল রাখবেন।

এই “খেয়াল রাখবেন” কথাটা আলোকে সারাদিন বয়ে নিয়ে চলে।

একদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে আলো হাঁটছে। আকাশে কালচে মেঘ। হঠাৎ বৃষ্টি নামল। ব্যাগটা মাথায় তুলে দৌড়াতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল। খুব বেশি আঘাত লাগেনি, কিন্তু হাঁটুতে ব্যথা।

ঘরে পৌঁছে বসে বসে ব্যথার জায়গাটা চেপে ধরল। মাকে কিছু বলল না। ভাইরা ভয় পাবে। ফোনটা হাতে নিল। অনেকক্ষণ ভেবেও কাউকে কল দিল না।

কিছুক্ষণ পর ফোনটা বেজে উঠল।

নীল।

— বৃষ্টি হচ্ছে না ওখানে?
— হচ্ছে।
— আপনি এখন কোথায়?

আলো একটু থেমে বলল,
— বাসায় পৌঁছেছি।

নীল যেন নিঃশ্বাস ফেলল।
— ভালো। রাস্তা ভিজে থাকে, সাবধানে হাঁটবেন।

আলো হাসল।
— এখন তো আর হাঁটার দরকার নেই।

নীল বুঝল না, আলো পড়ে গেছে। আলো বললও না। কিন্তু ফোনটা কেটে দেওয়ার পর তার মনে হলো—এই কথোপকথনটাই যেন ব্যথাটা একটু কমিয়ে দিল।


দিনের পর দিন এভাবেই চলতে লাগল।

কোচিং সেন্টারে আলো ভালো করতে শুরু করল। পরীক্ষায় নম্বর বাড়ছে। একদিন খুব আনন্দ নিয়ে নীলকে ফোন দিল।

— আজ টেস্টে ভালো করেছি।

নীল সত্যিই খুশি হলো।
— জানতাম পারবেন।

— আপনি কী করে জানলেন?
— আপনি চেষ্টা করেন। যারা চেষ্টা করে, তারা একদিন না একদিন ভালো করেই।

আলো চুপ করে রইল। কেউ এত সহজভাবে তার ওপর বিশ্বাস রাখবে—সে অভ্যস্ত নয়।

নীল নিজের জীবনের কথাও ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল। বাবার অসুখ, সংসারের দায়, গ্রামের মানুষের কথা। সে কখনো অভিযোগ করে না। কিন্তু আলো বুঝতে পারে—এই মানুষটার কাঁধেও অনেক ভার।

একদিন আলো বলল,
— আপনি সবসময় অন্যদের কথা ভাবেন।

নীল হেসে বলল,
— কেউ তো ভাববে।

— নিজের কথা ভাবেন না?
— মাঝে মাঝে ভাবি। কিন্তু তেমন সময় পাই না।

এই কথার পর আলো অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর ধীরে বলেছিল,
— আপনি অসুস্থ হলে আমাকে জানাবেন।

নীল কিছু বলল না। কিন্তু ওই মুহূর্তে সে বুঝে গিয়েছিল—কেউ একজন তার কথা ভাবছে।


এক সন্ধ্যায় আলো কোচিং থেকে ফিরছে। গাজীপুরের রাস্তা তখন ভিড়ে ঠাসা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার, হইচই, বিশৃঙ্খলা।

আলো একটু ভয় পেয়ে গেল। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল।

— কোথায় আছেন? নীলের গলা।

— রাস্তায়। লাইট নেই।

— ওখানেই থাকুন। ভিড়ের মধ্যে যাবেন না।
— ঠিক আছে।

নীল ফোনে লাইন কাটল না। আলো দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশের অন্ধকারটা আর ততটা ভয় লাগছিল না। ওপাশে কেউ আছে—এই জানাটাই যথেষ্ট।

বিদ্যুৎ এলে নীল বলল,
— এখন ধীরে ধীরে যান।

— আচ্ছা।

ফোনটা কেটে গেল। আলো হাঁটতে হাঁটতে ভাবল—এই মানুষটা কোনোদিন কিছু দাবি করেনি। তবু ঠিক সময়ে পাশে থাকে।


মাঝেমধ্যে দুজনেরই মনে হয়—এভাবে আর কতদিন?
কিন্তু কেউ কিছু বলে না।

নীল ভাবে, আলোর জীবনে এমনিতেই অনেক চাপ। সে বাড়তি কিছু হয়ে উঠতে চায় না।
আলো ভাবে, নিজের অবস্থানটা সে জানে। স্বপ্ন দেখলে ভেঙে পড়ার ঝুঁকি আছে।

তবু কাউকে ছাড়া দিনটা অসম্পূর্ণ লাগে—এই সত্যটা দুজনেই বুঝে ফেলেছে।

একদিন রাতে আলো বলল,
— জানেন, আগে কাউকে এভাবে নিজের দিনের কথা বলতাম না।

নীল বলল,
— এখন বলেন কেন?

— জানি না। সহজ লাগে।

নীল হাসল।
— আমারও।

সেই রাতে কেউ “ভালোবাসি” বলেনি। তবু কথাগুলোর ভেতরে এক ধরনের নিশ্চয়তা ছিল।


কয়েক মাস পর এক শুক্রবার নীল ঢাকায় এলো। কাজের ফাঁকে আলোকে ফোন করল।

— আজ কি একটু সময় পাবেন?

আলো চুপ করে রইল। তারপর বলল,
— সন্ধ্যায় ছুটি আছে।

তারা দেখা করল—কোনো সিনেমা হলে নয়, কোনো রেস্টুরেন্টে নয়। এক চায়ের দোকানে। আগের মতোই।

কিন্তু এবার নীরবতাটা অন্যরকম।

নীল বলল,
— আপনাকে সামনে দেখে ভালো লাগছে।

আলো নিচু গলায় বলল,
— আমারও।

চা শেষ হলো। কেউ উঠল না। কথা কম, উপস্থিতি বেশি।

নীল হঠাৎ বলল,
— যদি কোনোদিন মনে হয়, আমি দরকার… বলবেন।

আলো তাকাল। চোখে জল নয়, কিন্তু গভীর কিছু।
— আপনি তো এমনিতেই আছেন।

এই কথাটার কোনো জবাব নীল দিতে পারল না।


রাত নামল। আলাদা হতে হলো। বিদায়ের সময় কেউ হাত বাড়াল না, কেউ প্রতিশ্রুতি দিল না।

তবু দুজনই জানত—এখন তারা একা নয়।

প্রেমটা উচ্চারণে নয়।
প্রেমটা অপেক্ষায়।
প্রেমটা খোঁজখবরে।
প্রেমটা পাশে থাকার চেষ্টায়।

কিছু ভালোবাসা চুপচাপ বড় হয়।
ঠিক আলোর মতো—নীরবে, কিন্তু গভীরভাবে।

গল্প এখানেও থামে না।
কারণ কিছু অনুভূতি থামতে জানে না।

চলবে…