শীত নামতে শুরু করেছে। পিলখানার বাতাসে এখন আর বর্ষার ভেজাভাব নেই, আছে এক ধরনের শুষ্ক শীতলতা। সকালের কুয়াশা পাতলা, কিন্তু তার ভেতরে জমে আছে অদ্ভুত এক বিষণ্নতা। যেন এই জায়গা নিজেই বুঝে গেছে—কিছু একটা শেষ হতে চলেছে।
করিম মাহুত আজ আর ভোরে ওঠে না। শরীর আগের মতো সাড়া দেয় না। কাঁধের ব্যথা এখন নীরব এক সঙ্গী হয়ে আছে। তবু প্রতিদিন সূর্য ওঠার পর সে ধীরে ধীরে পিলখানার মাঠে আসে। গজরাজ তাকে দেখলেই শুঁড় তুলে ডাক দেয়। সেই ডাক আর আগের মতো গম্ভীর নয়—কেমন যেন টান ধরা।
রহমত এখন বাবার সঙ্গে হাঁটে। আগের মতো দৌড়ায় না। সে বুঝতে শিখেছে, নীরবতার ভাষা কীভাবে পড়তে হয়। পিলখানার প্রতিটি কোণ এখন তার কাছে চেনা, কিন্তু সেই চেনা জায়গার বুকেই ফাটল ধরেছে।
সাহেবদের অফিসঘরের সামনে আজ অস্বাভাবিক ভিড়। খবর ছড়িয়ে পড়েছে—আরও কয়েকটি হাতি পিলখানা ছাড়ছে। তালিকায় পরিচিত নাম। প্রতিটি নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি করে জীবন, একটি করে গল্প।
গজরাজের নাম এখনো নেই। কিন্তু এই ‘এখনো’ শব্দটাই সবচেয়ে ভয়ংকর।
এক দুপুরে করিমকে আবার ডাকা হলো। এইবার কথাবার্তা সংক্ষিপ্ত। সাহেবদের চোখে কোনো আবেগ নেই। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই।
“তুমি আর পূর্ণ সময়ের মাহুত নও,” বলা হলো।
“তোমার ছেলে চাইলে শিক্ষানবিশ হিসেবে থাকতে পারে।”
করিম চুপ করে রইল। তার বুকের ভেতর কিছু একটা ভেঙে গেল, কিন্তু মুখে তার ছাপ পড়ল না। শুধু বলল,
“গজরাজকে যেন ভালো রাখা হয়।”
সেই রাতে করিম অনেকক্ষণ গজরাজের পাশে বসে রইল। তার হাত বারবার হাতির কপালে বুলিয়ে যাচ্ছিল। গজরাজ শান্ত, কিন্তু চোখে অস্থিরতা। সে যেন বুঝতে পারছে—এই ছোঁয়াটা আলাদা।
“তুই আমার চেয়েও বেশি দিন বাঁচবি,” করিম ধীরে বলল,
“কিন্তু মনে রাখিস, তোকে মানুষ বানায়নি সাহেবরা—এই মাটিই বানিয়েছে।”
রহমত দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। তার চোখ ভিজে উঠল। সে বুঝতে পারল—বিদায় শুধু মানুষের নয়, সময়েরও।
কয়েক দিনের মধ্যেই করিম শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। শরীর আর সায় দেয় না। পিলখানার মাঠ তার কাছে দূরের কোনো স্বপ্ন হয়ে উঠল। তবু সে প্রতিদিন গজরাজের কথা জানতে চায়।
এক সকালে রহমত ছুটে এলো। খবরটা সে বলল না, শুধু বাবার হাত ধরল শক্ত করে। করিম তাকাল ছেলের দিকে। চোখে কোনো ভয় নেই, আছে শান্তি।
“গজরাজ…?”
এই ছিল তার শেষ প্রশ্ন।
করিম মাহুত মারা গেল নিঃশব্দে। কোনো শিঙ বাজল না, কোনো ঘোষণা হলো না। শুধু পিলখানার বাতাস একটু ভারী হয়ে উঠল।
সেই দিন গজরাজ অদ্ভুত আচরণ করল। সে খাবার খেল না। শুঁড় মাটিতে রেখে বসে রইল। কেউ তাকে এগিয়ে নিতে পারল না। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ সে শুঁড় তুলে এক দীর্ঘ ডাক দিল।
সেই ডাক ছিল না শক্তির, ছিল শোকের।
রহমত দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদল। সে বুঝতে পারল—এটাই বিদায়ের শব্দ।
করিমের দাফনের দিন পিলখানা স্বাভাবিক ছিল না। মাহুতেরা চুপচাপ। হাতিরা অস্থির। কেউ কেউ বলল—হাতিরাও নাকি মানুষ হারালে বোঝে।
দিনের পর দিন গজরাজ নিস্তেজ হয়ে পড়ল। নতুন মাহুতের কথা সে শুনতে চায় না। শুঁড় সরিয়ে নেয়। যেন বলছে—এই জায়গায় তার স্মৃতি ছাড়া কিছু নেই।
একদিন হঠাৎ খবর এলো—গজরাজকে অন্যত্র পাঠানো হবে।
রহমতের বুকের ভেতর শূন্যতা নেমে এলো। সে দৌড়ে গেল গজরাজের কাছে। শুঁড় জড়িয়ে ধরল।
“তোকে ছাড়া পিলখানা কী?”
সে ফিসফিস করে বলল।
গজরাজ ধীরে শুঁড় তুলল। রহমতের মাথায় রাখল। কোনো ভাষা নেই, তবু কথাটা থেকে গেল।
বিদায়ের সকাল এলো। গজরাজকে শিকলে বাঁধা হলো। পিলখানার ফটক খুলে গেল। সেই ফটক দিয়ে সে একসময় গর্ব নিয়ে বেরিয়েছিল—আজ বেরোচ্ছে নীরবে।
শিঙ বাজেনি। শুধু ভারী পায়ের শব্দ।
রহমত দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখের সামনে দিয়ে ইতিহাস হেঁটে চলে গেল।
পিলখানা সেই দিন বুঝে গেল—একটি যুগ শেষ হলো।
আর বাতাসে ভেসে রইল এক দীর্ঘশ্বাস—
হাতির শিঙ নয়, বিদায়ের শব্দ।
(চলবে…)