পিলখানার সকাল এখন আর কুয়াশায় ঢাকা নয়। সূর্য ওঠে ঠিকই, কিন্তু তার আলো পড়ে কংক্রিটের দেয়ালে, লোহার গেটে আর সারিবদ্ধ ভবনের ছায়ায়। পাখির ডাক শোনা যায়, তবে তা ক্ষণিকের—শহরের শব্দে দ্রুত চাপা পড়ে যায়। তবু এই জায়গার ভেতরে কোথাও এক ধরনের নীরবতা আছে, যা বাইরের কোলাহলের সঙ্গে মিশে না।
রহমত আজ অনেক দিন পর আবার এখানে এসেছে। শরীর দুর্বল, পা ধীরে চলে। হাতে একটি ছোট কাপড়ের ব্যাগ—ভেতরে কাগজ, পুরোনো ছবি, আর একটি নোটখাতা। সে জানে, ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। তাই দূরের ফুটপাতেই দাঁড়িয়ে আছে।
পিলখানার প্রবেশপথে পাহারা। পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা, নিয়ম—সবকিছু স্পষ্ট। আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু রহমতের চোখ এই দৃশ্যের ভেতর দিয়ে আরও গভীরে তাকায়।
এই গেটের নিচেই একসময় ধুলো উড়ত হাতির পায়ে। এখানেই বাবার কণ্ঠ শুনেছিল সে—“সাবধানে থাকিস, গজরাজ রেগে গেলে কেউ থামাতে পারে না।”
আজ সেই গজরাজ নেই। আছে প্রশিক্ষিত মানুষ, অস্ত্র, কর্তব্য।
সে ভাবল—রূপ বদলেছে, কিন্তু দায়িত্বের ভার কি হালকা হয়েছে?
একটি যুবক অফিসার গেটের পাশে দাঁড়িয়ে। রহমতের দিকে একবার তাকিয়ে ভদ্রভাবে মাথা নোয়াল। রহমত সেই দৃষ্টিতে কোনো ভয় বা অহংকার দেখল না—দেখল ক্লান্ত দায়িত্ববোধ।
সে বুঝল—বর্তমান পিলখানা শুধু অতীতের ছায়া নয়, এটি বর্তমানের বাস্তবতা।
রহমত ফুটপাথের ধারে বসে পড়ল। চারপাশে মানুষ চলছে—কেউ কাজে যাচ্ছে, কেউ ফিরছে। তাদের অনেকেই জানে না, এই জায়গার নিচে কত গল্প চাপা পড়ে আছে।
নোটখাতাটা খুলল সে। শেষ পাতায় এসে কলম ধরল। লিখল—
“পিলখানা আজও দাঁড়িয়ে আছে।
হাতি নেই, কিন্তু ইতিহাস আছে।
রক্ত আছে, কিন্তু শিক্ষা থাকুক।”
কলম থামাল। চোখ তুলে আবার গেটের দিকে তাকাল।
তার মনে হলো—যদি গজরাজ আজ থাকত, সে হয়তো এই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে শুঁড় তুলে ডাক দিত। সে ডাক শোনা যেত না, কিন্তু কম্পনটা টের পাওয়া যেত।
ঠিক যেমন ইতিহাস।
একটি বাস পাশ দিয়ে চলে গেল। শব্দে তার চিন্তা ভাঙল। নাতির কথা মনে পড়ল। সে নিশ্চয়ই একদিন ইতিহাস পড়বে—পিলখানা অধ্যায়। সেখানে থাকবে তারিখ, সংখ্যা, ঘটনা।
কিন্তু রহমত জানে—সব লেখা যায় না।
কিছু স্মৃতি মানুষে মানুষে বয়ে যায়।
সে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগ কাঁধে নিল। যাওয়ার আগে একবার পেছনে তাকাল। গেট, দেয়াল, পতাকা—সব স্থির।
কিন্তু তার ভেতরে যেন কেউ ফিসফিস করে বলল—
“ভুলে যাস না।”
রহমত হাসল না, কাঁদলও না। শুধু মাথা নোয়াল—এক ধরনের নীরব সম্মতির মতো।
হাঁটতে হাঁটতে সে বুঝল—বর্তমান পিলখানা কোনো একক গল্প নয়। এটি হাতি, মাহুত, শাসক, সৈনিক, রক্ত, স্মৃতি—সব মিলিয়ে এক দীর্ঘ যাত্রা।
শহর বদলাবে। আরও বদলাবে।
কিন্তু যদি কেউ থেমে শোনে,
এই জায়গা এখনো কথা বলে।
আর সেই কথাই ইতিহাস।