ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৬,
সময়: ০২:০৮:৩৩ PM

চলে গেলেন বেগম খালেদা জিয়া

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
30-12-2025 11:02:34 AM
চলে গেলেন বেগম খালেদা জিয়া

বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে আজ এক গভীর শূন্যতা। সব জল্পনা–কল্পনা ও দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমন সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। একই সঙ্গে দলটির সব অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়।

তার ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দীর্ঘ, বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।

দীর্ঘ অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই

দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগসহ নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। গত ২৩ নভেম্বর গভীর রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ও কোটি মানুষের দোয়া সত্ত্বেও আজ তিনি চিরবিদায় নিলেন।

গৃহবধূ থেকে গণআন্দোলনের নেত্রী

একসময়ের লাজুক ও প্রচারবিমুখ গৃহবধূ সময়ের প্রয়োজনে হয়ে উঠেছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের আপোষহীন নেত্রী। ১৯৪৫ সালে দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া খালেদা খানম পুতুল ছিলেন স্বভাবতই শান্ত ও সংযত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহের পর তার জীবন আবর্তিত হতো পরিবার ও সন্তানদের ঘিরে।

কিন্তু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের গতিপথ আমূল বদলে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুই শিশু সন্তানসহ তিনি ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন। সেই নয় মাস কাটে চরম অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয়ের মধ্যে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান।

রাজনীতিতে প্রবেশ ও আপোষহীন সংগ্রাম

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বেগম জিয়ার জীবনে এক ভয়াবহ মোড় নেয়। বিএনপি যখন অস্তিত্ব সংকটে, ভাঙন ও ষড়যন্ত্রে জর্জরিত, তখন দলের নেতা-কর্মীদের অনুরোধে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৩ সালে দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা তাকে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসকের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি আপোষহীন নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। দীর্ঘ নয় বছর রাজপথের আন্দোলন, গৃহবন্দিত্ব, লাঠিচার্জ ও নির্যাতন সহ্য করেও তিনি নীতির প্রশ্নে অবিচল ছিলেন। তার নেতৃত্বেই ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটে।

রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অবদান

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা তার অন্যতম ঐতিহাসিক কীর্তি।

তার শাসনামলে শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, অবকাঠামো ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটে। মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণ, টেলিযোগাযোগ খাত উন্মুক্তকরণ, পলিথিন নিষিদ্ধকরণ ও গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন তার সময়ের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ।

নির্যাতন, কারাবাস ও অবিচলতা

২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার সময় দেশত্যাগের চাপ প্রত্যাখ্যান করে তিনি কারাবরণ করেন। ২০০৯ সালের পর দীর্ঘ ১৬ বছর তাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়। বাসভবন থেকে উচ্ছেদ, গৃহবন্দিত্ব, অবরোধ, সন্তানের মৃত্যু—সবকিছু তিনি নীরবে সহ্য করেন।

২০১৮ সালে কারাবাসকালে পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে তার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ বারবার চাওয়া হলেও তা দেওয়া হয়নি। এসব নির্যাতনের মধ্যেও তিনি কখনো আপোষ করেননি।

মুক্তি ও শেষ বার্তা

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ৬ আগস্ট তিনি নিঃশর্ত মুক্তি পান। মুক্তির পর ভার্চুয়ালি দেওয়া তার বক্তব্যে প্রতিশোধ নয়, ভালোবাসা ও শান্তির আহ্বান ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এক ধ্রুবতারা, যার আলো নিভবে না

বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার এক অনন্য প্রতীক। নির্যাতন তার শরীরকে দুর্বল করতে পারলেও আদর্শ ও মনোবল ভাঙতে পারেনি। তার জীবন ছিল ত্যাগ, সংগ্রাম ও অবিচলতার এক মহাকাব্য।

আজ তিনি নেই, কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে তিনি চিরকাল এক ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলজ্বল করবেন—যার আলো কখনো নিভবে না।