ঢাকা, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৬,
সময়: ০৩:৫২:৫৭ PM

”এক শান্ত জনপদ” পর্ব–১

মান্নান মারুফ
29-12-2025 01:55:50 PM
”এক  শান্ত জনপদ” পর্ব–১

ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি নামেনি। কুয়াশার চাদরে ঢাকা বিস্তীর্ণ প্রান্তর নিঃশব্দে শুয়ে আছে। ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো আলো না পেয়ে অদ্ভুত এক নীরব দীপ্তি ছড়াচ্ছে। দূরে কোথাও একটি পাখি হঠাৎ ডানা ঝাপটাল। সেই ক্ষীণ শব্দেই কুয়াশার বুকের ভেতর যেন হালকা এক কাঁপন ছড়িয়ে পড়ল।

১৮৯৫ সালের ঢাকা—আজকের কোলাহল, ট্রাফিক জ্যাম আর ধোঁয়ায় ঢাকা শহরের সঙ্গে যার কোনো মিল নেই। তখন এই শহর ছিল সবুজে মোড়া এক শান্ত জনপদ। চারদিকে নদী–খাল–বিল, মাঝে মাঝে বিস্তৃত মাঠ। আর সেই ঢাকার এক প্রান্তে, যেন মানুষের চোখের আড়ালে গড়ে ওঠা রাজকীয় এক সাম্রাজ্য—পিলখানা।

পিলখানা নামটি উচ্চারণ করলেই রহমতের বুক কেঁপে উঠত। তার কাছে জায়গাটি শুধু হাতির আস্তানা নয়, এক জীবন্ত বিস্ময়। ‘পিল’ মানে হাতি, ‘খানা’ মানে আবাস—নামেই যার পরিচয়। ভোর হওয়ার আগেই এখানকার জীবন জেগে উঠত। কুয়াশার ভেতর থেকে ভেসে আসত ভারী পায়ের শব্দ। মাটি কেঁপে উঠত শত শত হাতির পদচারণায়। মনে হতো, পৃথিবী নিজেই যেন গভীর নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

রহমত দাঁড়িয়ে ছিল মাঠের ধারে। বয়স বড়জোর বারো। খালি পা, গায়ে পাতলা লুঙ্গি আর চোখে অদ্ভুত এক জাগরণ। আজ তার চোখে ঘুম নেই। কারণ আজ কোনো সাধারণ দিন নয়—এ কথা সে ভালো করেই জানে।

তার বাবা করিম মাহুত—পিলখানার পরিচিত নাম। অভিজ্ঞ, কম কথা বলেন, কিন্তু হাতিদের সঙ্গে কথা বলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। রহমত বহুবার দেখেছে, বাবা কানের কাছে কিছু বললে হাতি যেন বুঝে ফেলে।

আজ বড় সাহেবরা আসবেন—এই খবর গত দুদিন ধরে বাতাসে ভাসছে। কেউ বলছে শিকার, কেউ বলছে রাজকীয় শোভাযাত্রা। রহমতের বুকের ভেতর উত্তেজনা আর ভয় একসঙ্গে দোলা দিচ্ছে।

কুয়াশা ধীরে ধীরে পাতলা হতে শুরু করল। তখনই চোখে পড়ল সেই দৃশ্য—সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল হাতি। ধূসর শরীরগুলো ভোরের আলোয় রুপালি হয়ে উঠেছে। প্রতিটি হাতির পিঠে বসে আছে মাহুতরা। কারও মাথায় পাগড়ি, কারও গায়ে মোটা কাপড়ের জামা। হাতে লাঠি, চোখে অভিজ্ঞতার কঠিন দীপ্তি।

এরা শুধু পশুপালক নয়। এরা হাতির ভাষা বোঝে।

করিম মাহুত দাঁড়িয়ে আছে তার প্রিয় হাতি ‘গজরাজ’-এর পাশে। বিশাল কানের ভাঁজে মুখ রেখে সে ফিসফিস করে কিছু বলছে। গজরাজ ধীরে মাথা নাড়ল, শুঁড়টা মাটিতে ঠুকল। রহমত বাবার চোখে আজ অন্য রকম এক গাম্ভীর্য দেখল—যেমনটা যুদ্ধের আগে যোদ্ধাদের চোখে থাকে।

চারপাশে কোনো দালানকোঠা নেই। দিগন্তজোড়া মাঠ, মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ—বট, অশ্বত্থ, শিমুল। পাখিরা হাতির শিঙের শব্দে উড়ে যায়, আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় কাঁচা ঘাসের গন্ধ, হাতির শরীরের উষ্ণতা আর মাহুতদের হাঁকডাক।

ঠিক তখনই দূরে ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল।

ব্রিটিশ সাহেবরা এসে পৌঁছেছেন।

ঘোড়ায় চড়ে, সঙ্গে কয়েকজন দেশীয় সেপাই। চোখে কর্তৃত্ব, মুখে কৌতূহল। একজন সাহেব হাতির সারির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল,
“Magnificent!”

করিম শব্দটা বুঝল না। কিন্তু সুরটা বুঝল। তার বুকের ভেতর গর্ব আর ভয় একসঙ্গে দোলা দিল।

হঠাৎ শিঙের তীক্ষ্ণ শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল। প্রস্তুতির সংকেত। হাতিরা একসঙ্গে শুঁড় তুলে আওয়াজ করল। সেই শব্দ যেন আকাশে ধাক্কা খেল।

রহমতের বুক কেঁপে উঠল। তার মনে হলো—পিলখানা আজ কোনো জায়গা নয়, এক জীবন্ত উপকথা।

শোভাযাত্রা শুরু হলো।

(চলবে…)