ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাদের বিমা দাবির টাকা পাবেন না। কারণ, তারা যে বিমা পলিসি নিয়েছিলেন তার বেশিরভাগই কেবল উড়োজাহাজে থাকা অবস্থায় ক্ষতির জন্য প্রযোজ্য। এই পলিসির নাম ‘এয়ার রিস্ক অনলি’। অন্যদিকে, কিছু ব্যবসায়ী নিয়েছেন ‘এয়ার অল রিস্ক’ পলিসি, যা ওয়্যারহাউজ থেকে ওয়্যারহাউজ পর্যন্ত (Warehouse to Warehouse) পণ্য পরিবহনের পুরো সময়ের ক্ষতি কাভার করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিগুলো দুটি পলিসি ইস্যু করে— ‘এয়ার অল রিস্ক’ ও ‘এয়ার রিস্ক অনলি’। প্রথমটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং পণ্য গুদাম থেকে গন্তব্য গুদাম পর্যন্ত সম্পূর্ণ কাভারেজ দেয়। অপরদিকে, ‘এয়ার রিস্ক অনলি’ পলিসিতে বিমা কাভারেজ কেবল উড়োজাহাজে পণ্য ওঠানো থেকে নামানো পর্যন্ত সময়ের জন্য প্রযোজ্য। ফলে কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এই পলিসিধারী ব্যবসায়ীরা ক্ষতিপূরণ পাবেন না।
বিশ্বখ্যাত বিমা ও পুনঃবিমা বাজার লয়েড’স অব লন্ডন জানিয়েছে, তারা ‘এয়ার রিস্ক অনলি’ ধরনের কোনো পলিসি অনুমোদন করেনি। তবে সাধারণ বিমা করপোরেশন (SBC) বলছে, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নির্দেশনা অনুযায়ী এই পলিসিগুলো বৈধ এবং দেশে নিয়ম মেনেই ইস্যু করা হচ্ছে।
কার্গো ভিলেজের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা ‘অল রিস্ক’ পলিসি নিয়েছেন, তারা বিমা দাবির অর্থ পাবেন। কিন্তু যাদের ‘অনলি এয়ার রিস্ক’ পলিসি রয়েছে, তারা ক্ষতিপূরণের বাইরে থাকবেন।
জাগো নিউজের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ড-সংক্রান্ত ১০০টির বেশি বিমা দাবির মধ্যে বেশিরভাগই ‘অনলি এয়ার রিস্ক’ পলিসি।
গত ১৮ অক্টোবর দুপুরে শাহজালাল বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। দীর্ঘ নয় ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে পুরোপুরি নেভাতে সময় লাগে প্রায় ২৭ ঘণ্টা। এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (EAB) এর হিসাব অনুযায়ী, এতে আনুমানিক ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে। আর বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি (BCS) জানিয়েছে, তাদের সদস্যদের ক্ষতি প্রায় ৩৫ কোটি টাকার মতো।
তবে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ধারিত হয়নি। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে টাঙ্গাইলের ইউনিগ্লোরি পেপার অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার জানান, তাইওয়ান থেকে আমদানি করা তাদের সব মালামাল আগুনে পুড়ে গেছে। বিমা কোম্পানিতে দাবির আবেদন করলেও এখনো অর্থ পাননি। কেন ‘অনলি এয়ার রিস্ক’ পলিসি নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পণ্য আমদানির সময় বিমা করা বাধ্যতামূলক ছিল, তাই বিমা করেছি। কোম্পানি কখনো বলেনি এই পলিসিতে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে না।”
একইভাবে রংপুরের মেসার্স মহুবর রহমান পার্টিকেল মিলস লিমিটেডও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তাদের বিমা কাভার নোটে ‘এয়ার রিস্ক অনলি’ লেখা থাকায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া পণ্যের জন্য তারাও কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না।
বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে সবচেয়ে বেশি—৭৯টি বিমা দাবির আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৪৯টি ‘অনলি এয়ার রিস্ক’ পলিসি। কোম্পানির সিইও আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী বলেন, “অনলি এয়ার রিস্ক পলিসির আওতায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে যদি বিমানবন্দরের কার্গো সেকশন ফায়ার ইন্স্যুরেন্স কাভার রাখে, তাহলে কিছু দাবি বিবেচনা করা যেতে পারে।”
তিনি আরও জানান, এই ধরনের পলিসি বৈধ এবং গ্রাহক নিজের পছন্দমতো পলিসি নিতে পারেন। “অনলি এয়ার রিস্ক পলিসির প্রিমিয়াম কম, তাই অনেক ব্যবসায়ী খরচ বাঁচাতে এটি নেন,” বলেন তিনি।
এদিকে সাধারণ বিমা করপোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার শাহ আলম বলেন, “আইডিআরএর নিয়মেই দুটি পলিসি রয়েছে—‘অল রিস্ক’ ও ‘অনলি এয়ার রিস্ক’। রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত পলিসি হওয়ায় লয়েড’স অনুমোদন না দিলেও বাংলাদেশে এটি বৈধ।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, “‘অল এয়ার রিস্ক’ পলিসি দেয় ওয়্যারহাউজ টু ওয়্যারহাউজ কাভারেজ, আর ‘অনলি এয়ার রিস্ক’ কাভার করে শুধু বিমান ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত সময়ের ঝুঁকি। তাই কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনায় এয়ার রিস্ক অনলি পলিসিতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ নেই।”
এ ঘটনায় ব্র্যাক ব্যাংককেও প্রশ্ন করা হয়, কেন আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে ‘ওয়ারহাউজ টু ওয়্যারহাউজ’ পলিসি নিশ্চিত করা হয়নি। ব্যাংকটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক ‘ফ্রি অন বোর্ড’ (FOB) শর্তে পণ্য আমদানি করেছিলেন। এই শর্ত অনুযায়ী, জাহাজে পণ্য তোলার সঙ্গে সঙ্গেই সরবরাহকারীর দায় শেষ হয় এবং বিমা করার দায়িত্ব পড়ে আমদানিকারকের ওপর। ফলে, ‘এয়ার রিস্ক অনলি’ পলিসি নেওয়ার সিদ্ধান্তও তারই ছিল।
ব্র্যাক ব্যাংক আরও জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে তারা কোনো লেটার অব ক্রেডিট (LC) ইস্যু করেনি, বরং এটি চুক্তিভিত্তিক আমদানি ছিল। ব্যাংকটি ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (ICC) কর্তৃক প্রকাশিত ইউনিফর্ম রুলস ফর কালেকশন (URC ৫২২) অনুযায়ী কাজ করেছে, যেখানে ব্যাংকের বিমা বা গুদামজাতকরণ সংক্রান্ত কোনো দায় থাকে না।
সবশেষে বলা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির মুখে পড়া বহু ব্যবসায়ী হয়তো কোনো ক্ষতিপূরণই পাবেন না—শুধু বিমা পলিসির ধরন ভুল বেছে নেওয়ার কারণে।