ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫,
সময়: ০৬:৪২:৩০ PM

বিএনপি’র মাঝারি পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে অস্থিরতা

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
28-10-2025 12:38:39 PM
বিএনপি’র মাঝারি পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে অস্থিরতা

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে গেছে। মনোনয়নকে ঘিরে মাঠপর্যায়ের নেতা–কর্মীদের মধ্যে রেষারেষি ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মিত্র দলের কিছু নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও পেশাজীবীদের ‘সম্ভাব্য প্রার্থী’ হিসেবে আলোচনায় আসায় আসনভিত্তিক নেতৃত্ব নিয়েও ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে দলের ভেতরে। দীর্ঘদিন সংগঠনের দায়িত্ব পালন করা স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, তাদের উপেক্ষা করে বাইরের প্রার্থী ও শরিক দলের প্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এর পেছনে কাজ করছে দলীয় প্রভাব বিস্তার ও গ্রুপভিত্তিক তদবিরের রাজনীতি।

থানা বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বছরের পর বছর আমরা সংগঠন ধরে রেখেছি। এখন বাইরে থেকে কেউ এসে নেতৃত্ব নেবে—এটা মেনে নেওয়া কঠিন।”
আরেকজন বলেন, “মাঠের বাস্তবতা না বুঝে প্রার্থী নির্ধারণ করা হলে তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া সামলানো কঠিন হবে।”

তবে কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়েছেন, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। বিএনপির এক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, “দলীয় স্বার্থই মুখ্য বিষয়। মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা চলছে, তবে তৃণমূলকে উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।”


বিভিন্ন আসনে অস্বস্তি

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার অন্তত দশটি আসনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মিত্র দল বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সম্ভাব্য প্রার্থী করা নিয়ে আলোচনা চলছে।

ঢাকা–১৩ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম দীর্ঘদিন সংগঠন ধরে রেখেছেন। কিন্তু সম্প্রতি মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি আমিনুল হক এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে স্থানীয় নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির সদস্য আলমগীর হোসেন লাবু বলেন, “১৩ বছর ধরে আমরা আবদুস সালামের নেতৃত্বে কাজ করছি। বাইরে থেকে কাউকে আনা হলে তা অন্যায্য হবে।”
৩৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল ভূঁইয়া সোহেল বলেন, “দলের বাইরে কাউকে প্রার্থী করা হলে তৃণমূল হতাশ হবে, ভোটাররাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।”

আবদুস সালাম বলেন, “দলের পক্ষ থেকে ববি হাজ্জাজের জন্য কাজ করার কোনো নির্দেশনা পাইনি। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই চূড়ান্ত।”


ঢাকার বিভিন্ন আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা

  • ঢাকা–৬: বিএনপির ইশরাক হোসেন, কাজী আবুল বাশার এবং গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী।

  • ঢাকা–৭: বিএনপির মীর নেওয়াজ আলী, হামিদুর রহমান হামিদ, ইসহাক সরকার; মিত্র দলের প্রার্থী হিসেবে মাওলানা মামুনুল হক।

  • ঢাকা–৮: বিএনপির মির্জা আব্বাস; বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক।

  • ঢাকা–১০: বিএনপির ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, রবিউল ইসলাম রবি; সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

  • ঢাকা–১১: বিএনপির এম এ কাইয়ুম; এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

  • ঢাকা–১২: বিএনপির হাবিব উন নবী খান সোহেল, সাইফুল ইসলাম নীরব; গণসংহতির জোনায়েদ সাকি ও তাসলিমা আখতার।

  • ঢাকা–১৪: বিএনপির এস এ সিদ্দিক সাজু; মায়ের ডাক সংগঠনের সানজিদা ইসলাম তুলি।

  • ঢাকা–১৭: বিএনপির কামাল জামান মোল্লা; বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ।

  • ঢাকা–১৮: বিএনপির এস এম জাহাঙ্গীর; জেএসডির তানিয়া রব ও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না।


ঢাকার বাইরে অস্বস্তি

ঝিনাইদহ–২ আসনে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপির জেলা সভাপতি আব্দুল মজিদ ও গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান।

আব্দুল মজিদ বলেন, “দল যদি রাশেদকে মনোনয়ন দেয়, এ আসন হারাবে। তিনি এখানে সক্রিয় নন, স্থানীয় সমর্থনও তেমন নেই।”

তিনি আরও বলেন, “স্থানীয়রা চান—এই আসনে বাইরের নয়, স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত নেতাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক।”

পটুয়াখালী–৩ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাসান মামুন ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর প্রচারণায় ব্যস্ত।
হাসান মামুন বলেন, “নুরকে ছেড়ে দিলে বিএনপি এ আসন হারাবে। স্থানীয়রা বিএনপির প্রার্থী চায়, কোনো মিত্র দলের নয়।”

স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক ঘাঁটিতে নতুন মুখ এলে কর্মীদের মনোবল দুর্বল হবে, যা দলীয় ঐক্যে ভাঙন ধরাতে পারে।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি অন্তত ৫০–৭০টি আসনে শরিকদের জন্য ছাড় দিতে পারে। তবে এসব আসনে দীর্ঘদিন কাজ করা স্থানীয় নেতারা মনোনয়ন হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন।


“ধানের শীষ ছাড়া অন্য প্রতীক নয়”

বনানী থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ঈমান হোসেন নূর ইমন বলেন, “আমরা যারা জেল–জুলুমের শিকার, তারা শুধু ধানের শীষে ভোট দিতে চাই। বাইরে থেকে প্রার্থী এলে মনোবল ভেঙে যাবে।”

ঢাকা–১২ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাইফুল ইসলাম বলেন, “দল সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে, আর দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।”

ঢাকা–১৮ আসনের এস এম জাহাঙ্গীর বলেন, “দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেটাই মেনে নেব। তবে তৃণমূলের পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না পেলে তাদের মন খারাপ হবে।”


অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সতর্কতা

বিএনপির অনেক নেতা মনে করছেন, অতীতে শরিক দলের প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় দল বিব্রত হয়েছিল। যেমন—মিরপুরে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ধানের শীষে ৬১ হাজার ভোট পেয়েছিলেন; গণফোরামের সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান ধানের শীষে জয়ী হলেও পরে দল থেকে সরে যান।

তাদের মতে, ঢাকা শহরের আসনগুলো বিএনপির রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। এখানে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন বা বিতর্কিত প্রার্থী আনা হলে তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে।

একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “আওয়ামী লীগও জনপ্রিয়তার চেয়ে তারকা, আমলা বা বাইরের লোক দিয়ে এমপি বানিয়ে ভুগেছে। বিএনপির সেই ভুল করা উচিত নয়।”

তৃণমূলের মতে, মিত্রদের সমন্বয় অবশ্যই জরুরি, তবে স্থানীয় বাস্তবতা উপেক্ষা করলে ঐক্যের এ কৌশলই উল্টো অস্বস্তির ফাঁদে পরিণত হতে পারে।


নভেম্বরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নভেম্বরের মধ্যেই ২০০ আসনে একক প্রার্থীকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, “শরিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যারা মনোনয়ন পাবেন না, তাদেরও যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হবে।”