পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পে চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়সংক্রান্ত নতুন একটি টেন্ডারে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ক্রয়–প্রক্রিয়ার শুরুতেই পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর)–এর গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম এবং সচিব মো. সাইদুর রহমান তদন্তের নির্দেশ দিলেও তদনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণে গড়িমসি চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
৭৬ কোটি টাকার নতুন টেন্ডার
সাম্প্রতিক এই টেন্ডারে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য ৭০৩ প্রকার চিকিৎসা সরঞ্জামসহ বিভিন্ন মালামাল সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। মোট আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৬ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। অভিযোগ অনুযায়ী, বিভিন্ন শ্রেণি ও বিভাগের পণ্য একত্রে একটি প্যাকেজে রাখা হয়েছে, যা পিপিআর–এর বিধানবিরোধী। নিয়ম অনুসারে প্রতিটি বিভাগ ও প্রকারভেদ অনুযায়ী আলাদা লটে দরপত্র আহ্বান করার কথা।
এ ছাড়া টেন্ডারের কারিগরি স্পেসিফিকেশন নিম্নমানের, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও মডেলের উল্লেখ রয়েছে এবং ওয়ারেন্টির মেয়াদ কম চাওয়া হয়েছে—যা পিপিআর অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়।
পূর্বের ১০৫ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি–মার্চ মাসে আগের সরকারের আমলে প্রায় ১০৫ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়েও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ৯টি প্যাকেজে এসব কেনাকাটার কার্যাদেশ দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস’ নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, সেসময় কার্যাদেশ প্রদানের পুরো প্রক্রিয়ায় ছিল ব্যাপক অনিয়ম, জাল–জালিয়াতি ও গোপন সমঝোতা। বিল পরিশোধ করা হলেও এখনো সব মালামাল বুঝে পাওয়া যায়নি; সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতির মানও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের, যেখানে ইউরোপ–আমেরিকার ভুয়া স্টিকার ও সিল পাওয়া যায়।
দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সূত্র জানায়, পূর্বের টেন্ডার–অনিয়মের সময় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ডা. দিলরুবা ইয়াসমিন লিজা। তাঁর স্বামী পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মশিউর রহমানও পুরো প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই চিকিৎসক দম্পতির বিরুদ্ধে পূর্বের অনিয়মের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি, তবুও তারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও পূর্বের দায়িত্ব–পদে বহাল আছেন।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, নতুন টেন্ডার প্রক্রিয়াতেও এ দম্পতি প্রভাব বিস্তার করছেন এবং আগের একই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্যাকেজ–স্ট্রাকচার তৈরি করা হয়েছে।
অভিযোগপত্র ও তদন্ত নির্দেশ
অভিযোগকারীদের একজন, একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মো. এনামুল ইসলাম, ২ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি লিখিত অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযোগে বলা হয়—
-
৭০৩টি আইটেম এক প্যাকেজে রাখার ফলে প্রতিযোগিতা বাধাগ্রস্ত হবে
-
নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড–মডেল উল্লেখ করে স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়েছে
-
ওয়ারেন্টির মেয়াদ কম
-
উৎপাদকের অনুমোদনপত্রের পরিবর্তে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনপত্র চাওয়া হয়েছে
-
এর ফলে মানসম্মত যন্ত্রপাতি সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন হবে
অভিযোগে আরও বলা হয়, পূর্বের ক্রয়ে নিম্নমানের যন্ত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া লেবেল ব্যবহার করা হয়েছিল; ফলে সেসব মালামাল গ্রহণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনীহা প্রকাশ করে।
এ পরিস্থিতিতে প্যাকেজটিকে পিপিআর অনুযায়ী বিভিন্ন লটে ভাগ করে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করার অনুরোধ জানানো হয়।
অভিযোগপত্রের অনুলিপি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সিপিটিইউর মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়েছে।
৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা অভিযোগটি আরও তদন্তের জন্য সচিবের কাছে পাঠান। সচিব অতিরিক্ত সচিবকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিলেও সেই নির্দেশ বাস্তবায়নে বিলম্বের অভিযোগ উঠেছে।