ঢাকা, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ০৯:৩৫:৫৩ PM

নিঃশব্দ ছায়া — পর্ব -১৪-১৫

মান্নান মারুফ
12-12-2025 07:55:36 PM
নিঃশব্দ ছায়া — পর্ব -১৪-১৫

কলিকে জমির কাগজপত্র সব বুঝিয়ে দিল নীল। সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কলি খুব মনোযোগ দিয়ে কাগজগুলো একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর নিজের হাতে সেগুলো ফাইল করে অফিস সহকারীকে ডেকে বলল,
— এগুলো ঠিকভাবে রেখে দিও। তিন দিন পরে তহশীল থেকে কাগজপত্র বুঝে নেবেন নীল সাহেব।

এ কথা বলেই কলি আবার অন্য প্রসঙ্গে ব্যস্ত হয়ে গেল। নীল অনুভব করল—কলি ইচ্ছে করেই তার দিকে তাকাচ্ছে না। চোখাচোখি হলেই যেন পুরোনো দিনের নরম সুর ভেসে উঠবে, আর সে সুরে কেউই থাকতে পারবে না। কলি তা চায়নি। সে চায়নি নীল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কোনো প্রসঙ্গ তুলুক। চায়নি পুরোনো ভুল, পুরোনো ব্যথা আবার সামনে এসে দাঁড়াক।

নীল ধীরে উঠে দাঁড়াল।
যেখানে দশ বছর আগেও কলি তার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলত, আজ সেই মেয়েটাই তাকে এমনভাবে এড়িয়ে চলছে যেন কোনোদিন তাকে চেনেনি—মনটা মোচড় দিয়ে উঠল।

কিন্তু নীল কলিকে দোষ দিতে পারল না।
রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তারা একে একে তার বুকে হানা দিল। কলির অভিমান—হ্যাঁ, তা যথার্থই। ছেলেমানুষির বয়সে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোতে নীলই অবহেলা করেছে কলিকে। প্রতারণা করেছে, যদিও তখন সেটা নীল প্রতারণা ভেবেই করেনি। সুমার সাথে হঠাৎ ঘনিষ্ঠতা, সম্পর্কের অভিনয়, আবেগ… সবকিছুতে হারিয়ে ফেলেছিল কলিকে। আর কলি? কিছু না বলে শুধু চেয়ে দেখেছিল। তারপর নিজেই সরে গিয়েছিল নীরবে।

নীলের বুক ভারী হয়ে এল।
বাসায় ফিরে সে যেন অন্য মানুষ। মা বারবার জিজ্ঞেস করলেন—
— বাবা, এসি ল্যান্ড অফিসে কাজ হলো?

নীল শুধু ‘হ্যাঁ’ বলে চুপ করে থাকল।
ডাল ভাত সামনে রেখেও খেতে পারল না।
মায়ের চোখে উদ্বেগ, কিন্তু নীলের মুখে কোনো শব্দ নেই। সারাদিনের শেষে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, অথচ নীলের মন আরও অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল। সে উপলব্ধি করল—নিজের অতীত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আসলে আজই শুরু হয়েছে।

রাতে ঘুম এল না।
শুয়ে শুয়ে সে কলির মুখ মনে করার চেষ্টা করল—আজকের কলি আর আগের সেই কলি কোনোভাবেই এক নয়। পুরোনো দিনের নরম আলো ছাপিয়ে আজকের কলির চোখে কঠোরতা, দূরত্ব আর অভিমান।

তিন দিন পর নীল আবার অফিসে গেল।
মনে আশা—অন্তত একবার চোখাচোখি হবে। হয়তো কলি একটা কথাও বলবে না, তবু দেখা তো হবে! কিন্তু না, সব আশা ভেঙে গেল এক মুহূর্তেই।

কলি দেখা করল না।
অফিস সহকারী এসে বলল—
— স্যার, ম্যাডাম ব্যস্ত। আমাকে দিয়েছেন, আপনি এগুলো নিন।

ফোল্ডার হাতে নীলের মন আরও ভারী হয়ে গেল। তবু সাহস করে জিজ্ঞেস করল—
— একটু দেখা করা যাবে না? এক মিনিটও না?

সহকারী অপ্রস্তুত গলায় বলল—
— ম্যাডাম বলেছেন… সময় দিতে পারবেন না। আর… উনি আপনার কাছে সরি বলেছেন।

নীল হাসল—কিন্তু সেই হাসিতে ছিল তীব্র কষ্টের ছায়া।
তিনি অনেকক্ষণ বসে থাকলেন। যেন সামান্য সময় কিনে নিতে চাইলেন, যদি হঠাৎ দরজা খুলে কলি বেরিয়ে আসে! কিন্তু কিছুই ঘটল না। আর অপেক্ষা অর্থহীন বুঝে ধীরে ধীরে অফিস থেকে বেরিয়ে এল তিনি।

বাড়ি ফিরে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল।
কলির দূরত্ব, তার অভিমান—সবই যৌক্তিক, কিন্তু তবু নীলের ভেতরে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েই চলেছে। দিনগুলো ভারী হতে থাকল। সময় পার হতে লাগল ধীরে ধীরে—অস্থিরতায়, অপরাধবোধে, স্মৃতিতে।

হঠাৎ একদিন নীলের মনে হল—এভাবে তো চলতে পারে না।
তাকে দেখা করতেই হবে কলির সাথে।
যা বলার আছে, না বলা কথাগুলো বলেই মুক্ত হতে হবে।

তারপর অনেক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারল—
কলি এই অফিসে আর নেই। তাকে বদলি করা হয়েছে।
হঠাৎ যেন নীলের বুকটা হু-হু করে উঠল।
এখন কি তবে আর দেখা হবে না?
সব কথাই কি অপূর্ণ থেকে যাবে?

রাতে নীল ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকল।
আকাশে চাঁদ—তবু মনটা আরও শূন্য।
বদলি হওয়া মানে কি কলি তাকে এড়িয়ে চলার একটা উপায় পেল?
না হলে অন্তত একটা বার্তা পাঠাত! কিছু তো বলত!

এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরতে ঘুরতেই নীল বুঝল—
অতীতের পাপ কেউ এভাবে ভুলে যায় না।
প্রতারণার ক্ষত শুকাতে সময় লাগে।
আর কলি… হয়তো আজও সেই পুরোনো দিনের হতাশা ভুলতে পারেনি।

কিন্তু নীলের মন মানল না।
একটা সিদ্ধান্ত নিল সে—
যদি আবার কখনো সুযোগ আসে, তবে এই নীরবতা ভাঙবে।
কলির সামনে দাঁড়িয়ে বলবে—
একবারের জন্য হলেও শুনে নাও, কলি… আমার ভুলের গল্পটা, আমার প্রায়শ্চিত্তের গল্পটা।

কিন্তু তার আগে খুঁজে বের করতে হবে কলিকে।
যেখানেই থাকুক, যেভাবেই থাকুক—
এই নীরব ছায়ার গল্প শেষ হবে না এখনই।

— চলবে —

 

নিঃশব্দ ছায়া — পর্ব ১৪ (নতুন সংস্করণ)

অফিসে নীলের সঙ্গে দেখা না করলেও কলি যে তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে—তা নয়। তিনি নীলের সামনে মুখ খুললেন না ঠিকই, কিন্তু সহকারীদের কাছ থেকে, তহশীলদারের মুখে, এমনকি নীলের কাগজপত্র জমা দেওয়ার সময়কার কথোপকথন—সবকিছু নিঃশব্দে জেনে নিচ্ছিলেন। নীল কী বলল, কীভাবে তাকাল, কাগজপত্র হাতে পেয়ে কি একটু হাসল—এমন ক্ষুদ্র ঘটনাও কলি না চাইতেও শুনে ফেলত। শুনে ফেলেই মনটা আঁকুপাঁকু করত।

কিন্তু সে নিজেকে কঠোর করে রাখল।
কারণ নীল তার জীবনের সেই অসমাপ্ত অধ্যায়—যা মনে পড়লে এখনও বুকের ভেতরটা মোচড় মেরে ওঠে।

 এর কয়েকদিন পরই বদলির অর্ডার পেয়ে অন্য জেলায় যোগ দিতে হল কলিকে। সহকর্মীদের হাসি-ঠাট্টা, নতুন পরিবেশ—সবকিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু রাতে ঘরে ফিরলেই নীরব দেয়াল তাকে মনে করিয়ে দিত—আজ নীলের সঙ্গে দেখা হলে কী হতো? সে কি এবার সত্যি কথা বলত? নাকি আবার আগের মতোই নীরবতা বেছে নিত?

অদ্ভুত এক টান ছিল ভেতরে।
চাইলেও সে নীলকে ভুলতে পারছিল না।
একসময় যাকে ভালোবেসে নিজের সবটুকু দিয়ে দিয়েছিল, সেই মানুষটিও যে আজ তার মনের অতলে ফিরে এসেছে—তা সে মানতে চাইছিল না। তবু সত্যি এটাই।

নতুন জেলায় কাজ শুরু করে বেশ কিছুটা সময় পার হলো। দাপ্তরিক কাজ, মাঠ পরিদর্শন, কিস্তির শুনানি—সবকিছুতেই ব্যস্ততা। কিন্তু ব্যস্ততা কখনোই মনকে পুরোপুরি দখল করতে পারে না। মাঝে মাঝে নীলের কথা মনে পড়লে কলির বুকটা হঠাৎ ভারী হয়ে যেত। সে নিজেকে তিরস্কার করত—
“এ পৃথিবীতে কে কাকে মনে রাখে? সবাই নিজের মত করে এগিয়ে যায়। শুধু আমিই বোধহয় একই জায়গায় আটকে আছি…”

নিজেকে ভুলিয়ে রাখতেই একদিন ছুটির বিকেলে পুরোনো ডায়েরিটা বের করল। পাতায় পাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি—নীলের সঙ্গে কাটানো মাঠের আড্ডা, লাইব্রেরির নীরবতা, টিফিন ব্রেকের হাসি… সেই স্মৃতিগুলো এখন তার জন্য কাঁটার মতো। তবু সেগুলো ছিঁড়ে ফেলতে পারল না। যে ভালোবাসা একসময় তার জীবনের আলো ছিল, তা মুছে ফেললেও কি অন্ধকারটা কমে যাবে?

ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল।
স্ক্রিনে দেখা গেল—মা কলিং

কলি ফোন ধরল।
— হ্যালো মা, কী হয়েছে?

মায়ের কণ্ঠ একটু অস্থির।
— মা, তুমি ভালো আছো তো? তোমাকে নিয়ে চিন্তা হয়। আর একটা কথা… তোমার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলেটা প্রশাসন ক্যাডারে। ভালো পরিবার, ভালো চরিত্র। ভেবেছি—তোমাকে জানাই…

মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই কলির মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।
বিয়ের প্রস্তাব—এই শব্দটা এখন তার কাছে হঠাৎ খুব অপরিচিত লাগল। যেন তার জীবন এমন একটা মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে কেউ তাকে ঠেলে দিচ্ছে, কিন্তু সে জানে না সামনে কোন পথ।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে কলি ধীরে বলল—
— মা… এই প্রসঙ্গ নিয়ে পরে কথা বলবো। এখন আমার মনটা ভালো নেই। তোমরা কেমন আছো?

মা নিশ্বাস ফেললেন।
— আমরা ভালো আছি মা। তুমি নিজের খেয়াল রাখো। তোমার কণ্ঠটা খুব ক্লান্ত লাগছে।
— না মা, ঠিক আছি… একটু কাজের চাপ।

কলি ফোনটা কেটে ধীরে বিছানায় বসে পড়ল।
বিয়ের প্রস্তাব—এখন?
যখন তার মন এখনও অতীতের দগদগে ক্ষত নিয়ে লড়ছে?
যখন নীলের কথা অকারণে এসে মাথার ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে?

সে নিজেকে প্রশ্ন করল—
“আমি কি নীলকে ভুলতে পেরেছি? যদি না পারি, তবে কি আমি অন্য কারো সঙ্গে নতুন করে শুরু করতে পারব?”

এই প্রশ্নের উত্তর সে জানে না।
তবে এটুকু জানে—নীল যেভাবে তার হৃদয়ে জায়গা করে আছে, তা অস্বীকার করার কোনো মানে হয় না।

তবু সবশেষে বাস্তবতা তাকে টেনে ধরল।
এ পৃথিবীতে তো কেউ কার জন্য থেমে থাকে না।
নীলও থাকবে না।
সম্ভবত সে তার নিজের মতো করে এগিয়ে গেছে, হয়তো নতুন কারো সঙ্গে জীবনের নতুন গল্প লিখছে।

কিন্তু তবু…
কেন যেন কলি অনুভব করল—নীলও তাকে ভুলতে পারেনি।
যেমন করে তাকিয়ে ছিল সেদিন, তেমনি করে হয়তো এখনো কোথাও বসে সে কলির কথাই ভাবছে।

অদ্ভুত এক অস্থিরতা মাথায় ঘুরতে লাগল।
জানালার বাইরে রাত আরও গভীর হয়ে উঠল।
কলি বুঝল—জীবনের মোড় এবার বদলাতে চলেছে।

কিন্তু কোন দিকে যাবে সেই মোড়—
এই সিদ্ধান্তটা তাকে খুব শিগগিরই নিতে হবে।

— চলবে —