রাজউকের ভূমি বরাদ্দ বিধিমালার ১৩/এ ধারাকে উপেক্ষা করে সংরক্ষিত কোটায় ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজন ও পছন্দের লোকজনের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে—হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমন চিত্রই উঠে এসেছে।বিধিমালা অনুযায়ী, সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দের একমাত্র যোগ্যতা হলো—প্রজাতন্ত্রের কাজে অথবা যে কোনো পেশায় জাতীয় পর্যায়ে ‘অসাধারণ অবদান’। তবে অবশ্যই আবেদনকারীকে বিজ্ঞপ্তির নির্ধারিত সময়ে আবেদন করে প্লট না পাওয়ার তালিকাভুক্ত ব্যক্তি হতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এসব নীতিমালা উপেক্ষা করে প্লট বরাদ্দ হয়েছে পছন্দনির্ভর, রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং ক্ষমতাধরদের সুপারিশে—তদন্ত কমিটি জানিয়েছে।
ড. মুনাওয়ার মাহমুদকে সংরক্ষিত কোটায় ১০ কাঠা প্লট
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর জামাতা ড. মুনাওয়ার মাহমুদ কোনো বিজ্ঞপ্তির সময় আবেদন করেননি। তিনি বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত একজন প্রকৌশলী, যার প্লটের প্রয়োজনীয়তাও নথিতে উল্লেখ নেই।
২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুশাসনের ভিত্তিতে রাজউকের বোর্ড সভায় তাকে সংরক্ষিত কোটায় ১০ কাঠা প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে মুনাওয়ার মাহমুদ আম-মোক্তারবলে প্লটটি তার শ্বশুরের মাধ্যমে ব্যবসায়ী এ কে আজাদের কাছে বিক্রি করে দেন।
নথিতে ‘অসাধারণ অবদান’ সম্পর্কিত কোনো ব্যাখ্যা নেই। তদন্ত কমিটির মন্তব্য—বিধি ও প্রসপেক্টাসের কোনো ধারাই এখানে অনুসরণ করা হয়নি।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দুই ছেলের প্লটপ্রাপ্তি
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে রাসেল আহমেদ বিজ্ঞপ্তির সময় আবেদন না করেও ২০১৪ সালে সংরক্ষিত কোটায় ১০ কাঠার প্লট পান। তার জাতীয় পর্যায়ের কোনো অবদানের উল্লেখ নথিতে নেই। পরিচয় হিসেবে শুধু তার বাবার নামই উল্লেখ আছে।
অন্যদিকে, তার আরেক ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, এমপিকেও একইভাবে সংরক্ষিত কোটায় আরো একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। তদন্ত কমিটির ভাষ্যে—এক্ষেত্রেও বিধিমালা উপেক্ষা করা হয়েছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজুর দুই দফা প্লট বরাদ্দ
সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু কোনো আবেদন ছাড়াই ২০১২ সালে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ৫ কাঠার প্লট পান। পরবর্তীতে তিনি প্লটের আয়তন বাড়ানোর আবেদনের পর মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক সুপারিশ ছাড়াই রাজউকের বোর্ড সভা তার প্লটকে ৭.৫ কাঠায় উন্নীত করে।
তদন্ত কমিটি বলেছে—এক্ষেত্রে স্পষ্টভাবেই আইন ও বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং তার ‘অসাধারণ অবদান’ সম্পর্কেও কোনো তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি।
সাইফুজ্জামান শিখরের পরিবারে তিনটি প্লট
সাবেক এমপি আসাদুজ্জামানের মেয়ে কামরুল লায়লা জলি প্রথমে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা হিসেবে আবেদন করে প্লট না পেলেও পরে মন্ত্রণালয়ের অনুশাসনে সংরক্ষিত কোটায় ৫ কাঠার প্লট পান।
একই কোটায় তার মা মিসেস মনোয়ারা জামান এবং ভাই সাইফুজ্জামান শিখরের নামে অতিরিক্ত দুটি প্লট বরাদ্দ করা হয়। একই পরিবারের তিন সদস্যের নামে তিনটি প্লট বরাদ্দের বিষয়টি তদন্ত কমিটি সরাসরি ‘বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সংরক্ষিত কোটার সীমা অতিক্রম
২০০৯ সালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০০০ প্লটের মধ্যে মাত্র ১০% (৬০০ প্লট) সংরক্ষিত রাখার বিধান থাকলেও বাস্তবে ৯৪২টি প্লট সংরক্ষিত কোটায় বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এর মধ্যে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিচারপতি ছাড়াও বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, ক্ষমতাসীনদের স্বজন ও সরকারী-বেসরকারি কর্মকর্তা এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন।
তদন্ত কমিটির অগ্রগতি
২০২৪ সালের ২৯ মে গঠিত তদন্ত কমিটি এখন পর্যন্ত ২০০টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম উদঘাটন করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
অতিরিক্ত ১০০টি প্লটের অনিয়মও শনাক্ত করা হয়েছে, যা শিগগিরই আদালত ও মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে।
কমিটির প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ—সংরক্ষিত কোটার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিধিমালাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নির্দেশনায় প্লট বরাদ্দ হয়েছে।
১৩/এ বিধিমালা অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ের বিশেষ অবদানের ভিত্তিতে সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা। কিন্তু তদন্ত কমিটির ভাষ্যে—২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়জুড়ে বরাদ্দপ্রাপ্তদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই যোগ্যতার কোনো প্রমাণ নেই, বরং সরাসরি প্রভাব, দলীয় আনুকূল্য এবং ক্ষমতাসীনের সুপারিশে এসব প্লট বরাদ্দ হয়েছে। ফলে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পসহ রাজউকের বহু প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিধি, প্রসপেক্টাস ও সরকারি নিয়ম নীতির গুরুতর লঙ্ঘন হয়েছে।