২০২৩ সালের ১৬ মার্চ হয় চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদের উপ-নির্বাচন। এতে নৌকা প্রতীকে জয়ী হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম। এলাকায় তিনি ‘রাজা’ নামে পরিচিত। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় রেজাউল করিম তার মালিকানাধীন কৃষিজমির পরিমাণ দেখান ১০৩ দশমিক ৫৪৫ শতায়শ। যার মূল্য তিনি দেখিয়েছেন ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার ৪২৪ টাকা।অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেজাউল করিম রাজা এসব জমির পুরোটাই কিনেছেন ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত, চার মাসের মধ্যে। ৮টি দাগের এসব জমি বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজায় পাশাপাশি লাগানো। বোয়ালখালী পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের মীরাপাড়া এলাকায় অবস্থান এসব কৃষিজমির। সে জায়গাতেই হওয়ার কথা ছিল চট্টগ্রাম ওয়াসার দেড় হাজার কোটি টাকার ভাণ্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পের গোমদণ্ডী অংশের ওয়াটার রিজার্ভার। সেখান থেকে পুরো বোয়ালখালী পৌরসভায় পানি সরবরাহের পরিকল্পনা ছিল ওয়াসার।ওয়াসার প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী, পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজার বিএস ১৫১৮৮-১৫১৯৫ এবং বিএস ১৫২১৪-১৫২১৯ পর্যন্ত মোট ১৩ দাগে ২ একরের বেশি জমি অধিগ্রহণ করার কথা ছিল। এরমধ্যে ৮ দাগে ১ একরের বেশি জায়গা কিনে নেন রেজাউল করিম রাজা। এসব জমি কেনার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করেন বোয়ালখালী পৌর যুবদলের আহ্বায়কসহ বিএনপি-আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। এসব কৃষি জমি পূর্ব গোমদণ্ডী এলাকায় হলেও রেজাউল করিম রাজার বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলার একেবারে শেষপ্রান্তের শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে।অনুসন্ধান বলছে, ওই স্থানে রিজার্ভার করার জন্য সুপারিশ করে ২০২০ সালের জুলাই মাসে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় ওয়াসা। ওয়াসায় এর আগে থেকেই উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত রেজাউল করিম রাজার ভাই মো. রাশেদ। তিনি ২০১৬ সালের শুরু থেকেই ভাণ্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পে নিয়োজিত। বর্তমানে তিনি সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। মূলত ওই স্থানটি মনোনীত করে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে প্রকৌশলী ভাই রাশেদের আগাম তথ্যে পরবর্তী মাসগুলোতে প্রকল্পস্থানের এসব জমি কিনে নেন রেজাউল করিম রাজা। লক্ষ্য ছিল, সরকারি জমি অধিগ্রহণের নিয়ম অনুযায়ী তিনগুণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। এতে প্রায় ৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল রাজার।এ জমি কেনা থেকে শুরু করে এলএ (জমি অধিগ্রহণ) ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আবেদন পর্যন্ত বোয়ালখালী সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, উপজেলা ভূমি অফিস থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখা পর্যন্ত অনিয়ম বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে ওই স্থানে রিজার্ভার না হলেও পুরো বিষয়টি তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।এরই মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম ও তার স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদের তথ্য চেয়ে ব্যাংক, বিমা ও সরকারি দপ্তরগুলোতে চিঠি দিয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। একই সঙ্গে প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখাতেও চিঠি দেয় দুদক।
জমি কিনতে ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি’ চক্র
বোয়ালখালী পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের স্থানীয় কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি নাছের আলী। তার মা আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে দুই দলিলে একই দাগের ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ জায়গা কেনেন রেজাউল করিম। এরমধ্যে ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি সম্পাদিত ১৯৪ নং দলিলের একজন সাক্ষী হলেন বোয়ালখালী পৌর যুবদলের আহ্বায়ক মো. লোকমান। ওই দলিলে ৮ শতাংশ জমির মূল্য ধরা হয় ১৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। মো. লোকমান ওই ওয়ার্ডের মীরা পাড়ার মৃত নোয়া মিয়ার ছেলে।একই দিন ২০১ নং দলিলে স্থানীয় দুই ভাই আবুল কাসেম, আবুল কালাম ও আমিনা বেগমের কাছ থেকে ১৮ শতাংশ জমি কেনেন রেজাউল করিম। যার দলিল মূল্য দেখানো হয় ৩৭ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। ওই দলিলের একজন সাক্ষী স্থানীয় যুবদল নেতা মো. মোরশেদ। মোরশেদ পূর্ব গোমদণ্ডী গ্রামের মৃত ছৈয়দ আলমের ছেলে।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, রেজাউল করিমের এসব জমি কেনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি ও কাউন্সিলর নেছার আলী।তবে বিষয়টি অস্বীকার করে নেছার আলী বলেন, রেজাউল করিম রাজা যে জায়গাগুলো কিনেছেন, তার মধ্যে আমার মায়ের কাছ থেকেও কিছু জায়গা কিনেছেন। আনোয়ারা বেগম যিনি, উনি আমার মা। দলিলে হয়তো আমার ভাই মো. ওয়াহেদ সাক্ষী হয়েছিলেন। আমি তখন বিদেশে ছিলাম। এখন আমার ভাই বিদেশে। রেজাউল করিম সাহেবের জমি কেনার সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন বলে দাবি করেন।এ ব্যাপারে কথা হলে বোয়ালখালী পৌর যুবদল আহ্বায়ক মো. লোকমান বলেন, রেজাউল করিম যে জায়গাগুলো কিনেছিলেন, সেগুলো বেচাকেনার ক্ষেত্রে আমরা ৫-৬ জন মিডিয়া (মধ্যস্থতা) করেছিলাম। কোনো দলিলে ৫ পারসেন্ট, কোনো দলিলে ৩ পারসেন্ট হিসাবে। তবে রেজাউল করিম কেন এসব জমি কিনেছিলেন, তা জানতাম না। রেজাউল করিমের সঙ্গে এরপর আর কোনো কথা হয়নি বলেও দাবি করেন লোকমান।
মো. লোকমান ওই দলিল বাদেও ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর সম্পাদিত আরও তিনটি দলিলের সাক্ষী। ওই তিন দলিলেরও জমির ক্রেতা হলেন রেজাউল করিম। অন্যদিকে যুবদল নেতা মো. মোরশেদ বলেন, আমরা বিএনপির রাজনীতি করি। তবে এখন দলের কোনো পদে নেই। জায়গাগুলো যারা বিক্রি করেছেন, তারা আমাদের পাড়ার। জমিগুলোও আমাদের এলাকায়। এ সূত্র ধরে কবলায় আমি সাক্ষী হয়েছি।দলিল বাজারমূল্যে নাকি মৌজামূল্যে হয়েছিল, জানতে চাইলে ওই দলিল মৌজামূল্যে হয়েছিল বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, এখানে প্রতিগন্ডার (১.৯৮ শতাংশ) মৌজা মূল্য ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। তবে বাজারমূল্য কম বলে দাবি করে মোরশেদ বলেন, এখানে গন্ডা দুই থেকে তিনলাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।পূর্ব গোমদণ্ডীতে হচ্ছে না সেই রিজার্ভার
ওয়াসার ভাণ্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্প প্রস্তাবনায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত হচ্ছে না আলোচিত সেই রিজার্ভার। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসন পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজায় প্রকল্পের সেই জায়গা অধিগ্রহণ থেকেও ফিরে এসেছে। মূলত জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান পুরো বিষয়টি তদন্ত করে জমি অধিগ্রহণের অনিয়মের প্রমাণ পান। পাশাপাশি স্থানীয় প্রয়াত সংসদ সদস্য মোসলেম উদ্দিন চৌধুরীও প্রস্তাবিত ওই জায়গা বাদ দিয়ে বিকল্প স্থানে পানির রিজার্ভার করার জন্য ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে ডিও দেন।ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজার বিএস ১৫১৮৮, ১৫১৮৯, ১৫১৯০, ১৫১৯১, ১৫১৯২, ১৫১৯৩, ১৫১৯৪, ১৫১৯৫, ১৫২১৪, ১৫২১৫, ১৫২১৬, ১৫২১৭, ১৫২১৮ এবং ১৫২১৯ দাগের ২ একর ৮ শতাংশ জায়গায় বোয়ালখালী পৌরসভা এলাকায় পানি সরবরাহের জন্য রিজার্ভার করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়ে ২০২০ সালের জুলাই মাসে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে প্রকল্প স্থানের জায়গার খতিয়ান সংগ্রহ করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট জমি অধিগ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে প্রস্তাবনা দেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। এরপর জেলা প্রশাসন থেকে ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় হিসেবে ১৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ওই টাকা জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখাকে প্রদান করে ওয়াসা। এরপর দ্রুত অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করার প্রস্তুতি নেয় জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা।এলএ শাখার একটি চক্রও দ্রুত ওই জায়গার ক্ষতিপূরণ প্রদানে তৎপর হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে জমি অধিগ্রহণের অনিয়ম ও স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক মতানৈক্য হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াসা ওই স্থানে রিজার্ভার করার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে। ওয়াসার সুপারিশে চলতি বছরের ২৩ মার্চ প্রকল্পের পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজায় চাহিত জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বাতিল করে ওয়াসাকে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ও ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম বলেন, পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজায় আমরা একটি পানির রিজার্ভার করার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। এটি আমাদের প্রকল্প প্রস্তাবনায় ছিল। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে জটিলতা তৈরি হলে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই স্থানে রিজার্ভার না করার সিদ্ধান্ত হয়। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বাতিল করে আমাদের চিঠি দিয়েছে। এখন ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য যে ১৪ কোটি টাকা জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছিল, তা ফেরত নেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মো. আবু রায়হান দোলন বলেন, ওয়াসার প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে ভাণ্ডালজুড়ি প্রকল্পে পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজায় জমি অধিগ্রহণ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। জমি অধিগ্রহণের জন্য আমরা ফিল্ড ওয়ার্ক করেছিলাম। তবে কাউকে কোনো জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। পরে ওয়াসার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই জায়গা অধিগ্রহণ বাতিল করা হয়।
অস্বাভাবিক জমি হস্তান্তরের চেষ্টা অনুসন্ধানে দুদক
চট্টগ্রাম ওয়াসার ভাণ্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পের বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজায় অধিগ্রহণের জমি অস্বাভাবিকমূল্যে হস্তান্তর করে দলিল গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করে অবৈধভাবে লাভবান হওয়াসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ মার্চ তারিখের দুদক প্রধান কার্যালয়ের পত্রসূত্র ০৪.০১.১৫০০.৬২২.০১.০৩৮.২৩.চট্ট-১/৯৫০৭ পত্রের আলোকে দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক জুয়েল মজুমদারকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর অনুসন্ধান কর্মকর্তা জুয়েল মজুমদার বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, বোয়ালখালী ভূমি অফিস, চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে চিঠি দেন।
গত ২৩ জুলাই একটি তফসিলি ব্যাংকে এ নিয়ে চিঠি দেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। চিঠিতে পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজায় ওয়াসার রিজার্ভার প্রকল্পের জমি ক্রেতা বোয়ালখালী উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম, তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম, দুই সন্তান মোহাম্মদ সারোয়ার করিম এবং সাজরিন করিম রাইসার বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়। তাদের নামে কোনো ব্যাংক হিসাব, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র বা অন্য কোনো বিনিয়োগ হিসাব খোলা হয়ে থাকলে সে সংক্রান্ত ব্যাংক হিসাব বিবরণী এবং তাদের নামে কোনো ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকলে ঋণের বর্তমান স্থিতিসহ পরিশোধের বিবরণীসহ তথ্য চাওয়া হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ‘গণমাধ্যমের কাছে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই’ বলে জানান।এ বিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার উপ-সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা এএইচএম আলী আজম খানের সঙ্গে। তিনি ওই ভূমি অধিগ্রহণ ক্ষতিপূরণ প্রদান প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনিও ওই ক্ষতিপূরণ দ্রুত প্রদানের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ক্ষতিপূরণের চেক প্রদান সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, মমিনুর রহমান স্যার (সাবেক জেলা প্রশাসক) থাকার সময়ে তিনি প্রকল্পের স্থান ভিজিট করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তৎকালীন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও) মাসুমা জান্নাতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর মাসুমা জান্নাত ম্যাডাম আমার কাছ থেকে ফাইলটি নিয়ে গিয়েছিলেন। আর দেননি। এলএ ক্ষতিপূরণ প্রদানে কারো একার কাজ নেই বলে দাবি করেন তিনি।দুদকের চিঠির বিষয়ে তিনি বলেন, পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজায় ওয়াসার জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে তথ্য চেয়ে দুদক থেকে চিঠি দিয়েছিল। এরই মধ্যে আমরা দুদকে কিছু তথ্য দিয়েছি। তবে অধিগ্রহণ মামলার ফাইলটি এখন আমার কাছে নেই।প্রকল্পটি বাতিল হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি। বলেন, আপনারা (প্রতিবেদক) এসব বিষয়ে লেখালেখি করলে তহসিল অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, ভূমি অফিসের লোকজনসহ অনেকে বিপদে পড়ে যাবে।
যা বলছেন দুই ভাই
ওয়াসার সহকারী প্রকৌশলী মো. রাশেদ। তিনি শুরু থেকেই ভাণ্ডালজুড়ি প্রকল্পে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি বোয়ালখালী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিমের আপন ভাই। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানোর পর তার তথ্যের ভিত্তিতে ভাই রেজাউল করিম ওয়াসার চাহিত প্রকল্প স্থানের জমি কেনেন। এতে অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগও ওঠে। এর মাধ্যমে দুই কোটি ৪৪ লাখ টাকায় কেনা জমি দিয়ে অল্প সময়ে অধিগ্রহণ ক্ষতিপূরণ থেকে সাড়ে ৭ কোটি টাকা আয়ের কৌশল ছিল তাদের। সরকারি নিয়ম মোতাবেক মূল্যের তিনগুণ অধিগ্রহণ ক্ষতিপূরণ পান জমির মালিকরা।
এ ব্যাপারে কথা হলে, সহকারী প্রকৌশলী মো. রাশেদ বলেন, প্রকল্পের স্থান নির্ধারণে আমার কোনো হাত নেই। এগুলো টপ ম্যানেজমেন্ট দেখে। পূর্ব গোমদণ্ডী মৌজায় কোনো রিজার্ভার হওয়ার কথা ছিল কি না, সেটাও আমি জানি না। জমি কেনার বিষয়ে আমার ভাইকে তথ্য দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। রেজাউল করিম আমার ভাই হলেও আমরা আলাদা থাকি। এ নিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি।
বোয়ালখালী উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাজা বলেন, ওয়াসা কী করবে না করবে, সেটা আমার ব্যাপার না। আমি কিনেছি ফার্ম করার জন্য। এগুলো কৃষি জমি। এখানে অন্য মানুষও জমি কিনেছে। আপনি (প্রতিবেদক) আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমার সাক্ষাৎকার নেন। ওয়াসার সহকারী প্রকৌশলী মো. রাশেদের বিষয়ে তিনি বলেন, রাশেদ আমার ভাই। আমরা পাঁচ ভাই। সবাই আলাদা থাকি।জমিগুলো কখন কেনা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কখন কিনেছি আমার মনে নেই। এগুলো কখন অ্যাক্যোয়ার (অধিগ্রহণ) করেছে সেটিও আমার জানা নেই।
দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে তিনি বলেন, দুদক অনুসন্ধান করুক। দুদক আমার কাছ থেকে যা যা ডকুমেন্ট চেয়েছে আমি তা দিয়েছি। জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন তিনি।এ ঘটনাটিকে পদ্মা সেতুর অভিযোগের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। বলেন, এগুলো-তো পদ্মা সেতুর মতো হয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো এখানে একই জিনিস হয়েছে। পদ্মা সেতুতে একটি জিনিসকে খোঁচাতে খোঁচাতে লম্বা করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর টেন্ডারই হয়নি, অথচ বলা হয়েছিল দুর্নীতি হয়েছিল। এখানেও কোনো জমি অ্যাকোয়ার (অধিগ্রহণ) হয়নি। কিন্তু বলা হচ্ছে দুর্নীতি হয়েছে।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি ভাণ্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। তখন প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তবে প্রকল্পের শুরুতে ভূমি জটিলতায় তিন বছর আটকা পড়ে প্রকল্পটি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রথম দফায় সংশোধিত হয়ে মেয়াদ দাঁড়ায় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৯৯৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এরপর দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত হয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।এ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৬ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, বোয়ালখালী, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী এলাকার শিল্পাঞ্চল ও আশপাশের সাধারণ মানুষের পানি সংকট দূর করার লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্পটি হাতে নেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১০ লাখ মানুষকে সুপেয় পানির আওতায় আনার চিন্তা রয়েছে ওয়াসার। এ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে পটিয়া পৌরসভার ইন্দ্রপুল বাইপাস এলাকায় ৫ একর জায়গায় এবং আনোয়ারা উপজেলার দৌলতপুর মৌজায় ২ দশমিক ৯৪ একর জায়গায় দুটি রিজার্ভার নির্মাণ সম্পন্ন করেছে ওয়াসা।