ঢাকা, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫,
সময়: ১০:৫৪:৪৬ PM

রূপ ও সৌন্দর্য হারাচ্ছে হাতিরঝিল

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
26-10-2025 07:28:11 PM
রূপ ও সৌন্দর্য হারাচ্ছে হাতিরঝিল

একসময় রাজধানীর প্রাণবন্ত বিনোদনকেন্দ্র ছিল হাতিরঝিল। ঝকঝকে রাস্তা, স্বচ্ছ জলরাশি, আধুনিক আলোকসজ্জা ও মনোরম পরিবেশে ভরপুর ছিল এই এলাকা। কিন্তু দায়িত্বহীনতা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও অব্যবস্থাপনার কারণে নগরবাসীর প্রিয় স্থানটি এখন ভাঙাচোরা রাস্তা, দুর্গন্ধ ও নিরাপত্তাহীনতার জন্য কুখ্যাত হয়ে উঠেছে। শহরবাসীর স্বাচ্ছন্দ্যময় চলাচল এখন মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে। হাতিরঝিলের নান্দনিকতা আজ কেবলই অতীত স্মৃতি। ২০১৩ সালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে উদ্বোধন হয় হাতিরঝিল প্রকল্পের। রাজধানীর অন্যতম সফল নগরায়ণ উদ্যোগ হিসেবে এটি স্বীকৃতি পায়। লেক, সেতু, উড়ালসড়ক, ফুটপাথ, জলাধার—সব কিছুই পরিকল্পিতভাবে নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধান শেষ হয়ে রাজউকের হাতে দায়িত্ব যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় অবনতি। প্রাথমিক পর্যায়ে সামান্য ত্রুটি দেখা দিলেও সময়ের সঙ্গে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।সরেজমিনে দেখা গেছে, হাতিরঝিলের চারপাশের রাস্তা এখন গর্তের ফাঁদে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টি হোক বা রোদ—সব মৌসুমেই একই দুরবস্থা। কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও পাথর বেরিয়ে পড়েছে। বৃষ্টির পানি জমে গর্ত ঢেকে যায়, ফলে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার কিংবা রিকশা চালানো হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই পথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে চলাচল করেন। ফার্মগেট থেকে তেজগাঁও হয়ে রামপুরা পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটারের এই সড়ক একসময় ছিল শহরের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও মনোরম পথ। কিন্তু এখন তা খানাখন্দে ভরা।

রাতে পর্যাপ্ত আলোর অভাবে পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢেকে যায়, সুযোগ নেয় ছিনতাইকারীরা। লেকের পানি কালচে হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়, আশপাশে জমে থাকা আবর্জনা ও আগাছায় হারিয়ে গেছে সৌন্দর্য। রাজউকের হাতিরঝিল ব্যবস্থাপনা অফিসের সামনেও এখন অব্যবস্থাপনার চিত্র প্রকট। সামান্য বৃষ্টিতেই ভবনের সামনে হাঁটুপানি জমে। ভেতরে সিঁড়ির নিচে ঘুমায় কুকুর, রিসেপশনে থাকে না কেউ। ভবনটি এখন মূলত গাড়ির গ্যারেজ ও পার্কিং স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

একজন অফিস সহকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এখানে তেমন কোনো প্রশাসনিক কাজ হয় না। কর্মকর্তারা মতিঝিল অফিস থেকেই কাজ করেন।”

হাতিরঝিলের একসময়ের জনপ্রিয় ওয়াকওয়ে ও পার্কগুলো এখন প্রায় পরিত্যক্ত। কোথাও ভাঙা বেঞ্চ, কোথাও উঠে গেছে টাইলস, কোথাও ঘাসে ঢেকে গেছে হাঁটার পথ। তরুণদের আড্ডার জায়গা এখন নোংরা ও অরক্ষিত। রাতের বেলা পুরো এলাকা নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে শুধু মোটরসাইকেলের শব্দ বা ছিনতাইকারীদের আনাগোনা শোনা যায়।

স্থানীয় বাসিন্দা বেলার হোসেন বলেন, “একসময় এই জায়গাটা এত সুন্দর ছিল যে, সন্ধ্যার পর পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসতাম। এখন দুর্গন্ধে দাঁড়ানোই যায় না। রাস্তার গর্তে দুর্ঘটনা ঘটে প্রায়ই, আর রাতে আলো না থাকায় ছিনতাই বেড়েছে। বছরের পর বছর কোনো সংস্কার হয় না।”

প্রাইভেটকার চালক দেলায়ার হোসেন বলেন, “এখন এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো মানেই যুদ্ধ করা। চাকা গর্তে পড়ে যায়, গাড়ির নিচের অংশ ঘষে যায় রাস্তায়। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা ডুবে যায়।”

মোটরসাইকেলচালক আসাদুজ্জামান জানান, “আমার এক বন্ধু গর্তে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। বৃষ্টিতে গর্ত ঢেকে যায় বলে বোঝাই যায় না কোথায় ফাঁদ।”

কুনিপাড়ার বাসিন্দা মাজহার আলী বলেন, “আগে সন্ধ্যায় এখানে লোকজন হাঁটত, শিশুরা খেলত। এখন কেউ আসতে চায় না—দুর্গন্ধ, আলো নেই, নিরাপত্তাহীনতা। পুরো এলাকা পরিত্যক্ত মনে হয়।”

স্থানীয় ব্যবসায়ী জামাল উদ্দীন বলেন, “সেনাবাহিনীর সময়ে হাতিরঝিল ছিল পরিচ্ছন্ন ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। রাজউক দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাস্তা ভাঙা, আলো নিভে যাওয়া, আবর্জনা জমা—সব শুরু হয়েছে। এখন এমন অবস্থা, রাতে কোনো নারী একা হাঁটতে পারে না।”

বাসিন্দাদের অভিযোগ, হাতিরঝিলের লেকের পানিও এখন অস্বচ্ছ ও দুর্গন্ধযুক্ত। চারপাশে ভাসমান আবর্জনা, পলিথিন ও প্লাস্টিক জমে আছে। এতে জলজ প্রাণীর সংখ্যা কমে গেছে, পানি কালচে হয়ে পড়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, লেকের পানি বিশুদ্ধ রাখতে নিয়মিত বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই; ফলে দূষণ দিন দিন বাড়ছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রকল্পটির আলাদা রক্ষণাবেক্ষণ কর্তৃপক্ষ গঠন জরুরি।

বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, “এমন বড় প্রকল্পগুলো টিকিয়ে রাখতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট থাকা জরুরি। আমাদের দেশে বেশির ভাগ অবকাঠামো প্রকল্প উদ্বোধনের পরই অবহেলায় পড়ে যায়। হাতিরঝিলও তার ব্যতিক্রম নয়। উন্নয়ন কেবল নির্মাণে সীমাবদ্ধ থাকলে তা টেকসই হয় না; রক্ষণাবেক্ষণ কাঠামো ও জবাবদিহিতা থাকতে হয়। সেটার অভাবেই এমন অবস্থা।”

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, “এখন এটি সিটি করপোরেশনের অধীনে, যদিও অবকাঠামোগত দিকগুলো রাজউক দেখভাল করে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় বা দায়বদ্ধতা নেই। দায়িত্বহীনতার কারণে কেউ শাস্তি পায় না, চাকরি হারায় না—এই সংস্কৃতিই অব্যবস্থার মূল কারণ। জবাবদিহিতা আর ভয় না থাকলে এমন অবহেলা চলতেই থাকবে।”