
ডলারের বাজার আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে। কয়েক মাসের শান্ত অবস্থা শেষে হঠাৎ করেই বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, এতে বিপাকে পড়েছেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে ব্যাংকাররা বলছেন, তারা কেবল “বাজারভিত্তিক মূল্যনীতি” অনুসরণ করছেন।বুধবার দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রতি ডলার বিক্রি করেছে সর্বোচ্চ ১২২ টাকা ৭৫ পয়সা দরে। মাত্র তিন কার্যদিবস আগেও এই হার ছিল ১২২ টাকা থেকে ১২২ টাকা ৩০ পয়সা। সাধারণ চোখে এ পার্থক্য ক্ষুদ্র মনে হলেও, যারা জাহাজভর্তি কাঁচামাল আমদানি করেন, তাদের জন্য এটি কোটি টাকার ক্ষতি।
চট্টগ্রামভিত্তিক এক ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“ব্যাংকগুলো ডলারকে ক্যাসিনোর খেলায় পরিণত করেছে। প্রতি বছরের ডিসেম্বরেই একই নাটক হয়—ডলারের দাম বাড়িয়ে মুনাফা দেখানো হয়, আর সেই বিল আমাদেরই দিতে হয়।”
তবে ব্যাংকারদের দাবি, কোনো প্রকার কারসাজি নয়, বরং এটি “বাজারনির্ভর হার”। এক ব্যাংকের ট্রেজারি কর্মকর্তার ভাষায়,
“আমরা কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন বিনিময় নীতিমালাই অনুসরণ করছি।”
নতুন নীতি, পুরনো সংকট
চলতি বছরের মে মাস থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) সংস্কার শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ “বাজারভিত্তিক বিনিময় হার” পদ্ধতি চালু করেছে। এর উদ্দেশ্য ছিল ডলারের কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা। কিন্তু বাস্তবে এতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ব্যাংকগুলোর মুনাফা-লোভী প্রবৃত্তি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান অস্থিরতা সাময়িক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মো. শাহরিয়ার সিদ্দিকী জানান,
“সরকারি পেমেন্টের কারণে ডলারের চাহিদা সাময়িকভাবে বেড়েছে। খুব শিগগিরই বাজার স্থিতিশীল হবে।”
কিন্তু ততদিনে আমদানিকারকদের রক্তক্ষরণ অব্যাহত। কারণ, প্রতিবার ডলারের দাম ৫০ পয়সা বাড়লেই আমদানির খরচ বেড়ে যায়, উৎপাদন ব্যয়ও তদনুসারে বৃদ্ধি পায়, যার প্রভাব পড়ে সার্বিক মুদ্রাস্ফীতিতে।
রপ্তানিকারকরাও অস্বস্তিতে
সাধারণত ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমলে রপ্তানিকারকরা খুশি হন। কিন্তু এবার তারাও উদ্বেগে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন,
“এটি প্রকৃত বাজারের প্রতিফলন নয়। কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বাড়ানো হলে পুরো অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়—আমদানির খরচ বাড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে, উৎপাদন ব্যাহত হয়। ডলারকে স্থিতিশীল করতে হবে, নইলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ
ইন্টারব্যাংক মার্কেটে গতকাল ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১২২ টাকা ২৫ পয়সা, যা আগের দিনের তুলনায় ২৫ পয়সা বেশি। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সামান্য পরিবর্তন আসলে গভীর অস্থিরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ২.১২ বিলিয়ন ডলার কিনেছে—এর মধ্যে গত সপ্তাহেই ৩৮ মিলিয়ন ডলার কেনা হয়েছে প্রতি ডলার ১২১ টাকা ৮০ পয়সা দরে। অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই এখন খেলোয়াড়ের ভূমিকায়।
এদিকে সেপ্টেম্বরে খোলা লেটার অব ক্রেডিট (এলসি)-এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগস্টের ৫.৩৮ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। ফলে বাজারে ডলারের চাহিদা আরও বেড়ে গেছে।
তবুও অনেকে মনে করেন, এর পেছনে প্রকৃত অর্থনৈতিক চাপ নয়, বরং “বছর শেষে মুনাফা দেখানোর চাপ” কাজ করছে। এক আমদানিকারক ব্যঙ্গ করে বলেন,
“এইভাবে চলতে থাকলে ডলারের বদলে পেঁয়াজ আর আলু দিয়ে বিল মেটানোই ভালো!”
শেষ কথা
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের ডলারবাজার আবারও পরিণত হয়েছে এক রকম বিরোধাভাসের মঞ্চে—যেখানে ব্যাংকাররা আইএমএফের সংস্কারনীতির দোহাই দিচ্ছেন, ব্যবসায়ীরা দিচ্ছেন ক্ষতির হিসাব, আর টাকাই যেন নিজের মৃত্যুঘোষণা লিখছে নীরবে।