ঢাকা, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫,
সময়: ০৫:৫৭:৪৬ PM

পাঁচ বছরে অগ্নিকাণ্ড নিহত ৭২০, ক্ষতি ৪০ কোটি

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
20-10-2025 02:07:33 PM
পাঁচ বছরে  অগ্নিকাণ্ড নিহত ৭২০, ক্ষতি  ৪০ কোটি

দেশে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, শিল্প-কারখানা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ‘উদ্দেশ্যমূলক’ অগ্নিকাণ্ড উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে (২০২০–২০২৪) দেশে এমন ৯৯০টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭২০ জন, আর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।একই সময়ের মধ্যে দেশে মোট অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এক লাখ ২১ হাজারের বেশি। তদন্তে দেখা যায়, এগুলোর মধ্যে ৯৯০টি আগুন ইচ্ছাকৃতভাবে লাগানো হয়েছিল— প্রতিশোধ, শত্রুতা বা সংঘাতের কারণে।

অগ্নিকাণ্ডের পেছনে শত্রুতা ও প্রতিশোধ

বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক দ্বন্দ্ব, জমি-বাণিজ্যিক বিরোধ, পারিবারিক কলহ এমনকি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা— এসবই উদ্দেশ্যমূলক অগ্নিসংযোগের মূল কারণ। অধিকাংশ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হলেও বেশিরভাগ মামলার অগ্রগতি হয় না, আর বিচারের মুখও দেখে না। এতে অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ায় সচেতনতা বাড়ছে না, বরং ধারাবাহিকভাবে ঘটছে নতুন অগ্নিকাণ্ড।

ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, অধিকাংশ আগুন দুর্ঘটনাজনিত হলেও শত্রুতামূলক অগ্নিকাণ্ডের প্রবণতা এখন “উদ্বেগজনকভাবে” বেড়েছে। তদন্তে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই আগুন লাগানো হয়েছিল পূর্বপরিকল্পিতভাবে বা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে

বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন

সর্বশেষ রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাশকতার প্রশ্ন উঠেছে। শুধু কার্গো ভিলেজ নয়— সম্প্রতি চট্টগ্রামের ইপিজেডসহ একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাতেও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি উঠেছে। এসব ঘটনায় কারও ইন্ধন থাকার অভিযোগও উঠেছে।

বিজিএমইএ জানিয়েছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের ওই আগুনে ক্ষতির পরিমাণ একশ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। ঘটনাটির তদন্তে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, সব ধরনের অভিযোগ আমলে নিয়ে কমিটি আগুনের আগে-পরে পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করবে।

বছরওয়ারি পরিসংখ্যান

ফায়ার সার্ভিসের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়,

  • ২০২৪ সালে ২৫০টি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা, নিহত ১৪১ জন

  • ২০২৩ সালে ২৩৬টি ঘটনায় ক্ষতি ৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা, নিহত ১০২ জন

  • ২০২২ সালে ১৫৭টি ঘটনায় ক্ষতি ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা, নিহত ৯৮ জন

  • ২০২১ সালে ১৬৭টি ঘটনায় ক্ষতি ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা, নিহত ২২৫ জন

  • ২০২০ সালে ১৮০টি ঘটনায় ক্ষতি ২১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, নিহত ১৫৪ জন

মোট পাঁচ বছরে নিহত হয়েছেন ৭২০ জন, আর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকারও বেশি

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মেদ খান বলেন, “একটির পর একটি বড় অগ্নিকাণ্ড কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। শাহজালাল বিমানবন্দর কেপিআইভুক্ত এলাকা, যেখানে সার্বক্ষণিক মনিটরিং থাকার কথা। সেখানে এত বড় আগুন লাগা এবং দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলে থাকা কর্তৃপক্ষের গাফিলতির ইঙ্গিত দেয়।”

তিনি আরও বলেন, “জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এসব ঘটনা দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করার প্রচেষ্টা হতে পারে।”

অন্য সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শহিদউল্লাহ বলেন, “ঘন ঘন আগুন লাগার ঘটনায় নাশকতার আলামত স্পষ্ট। দুর্ঘটনার আড়ালে কোনো সংগঠিত ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা জরুরি।”

অপরাধ বিশ্লেষকদের মত

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, “সাম্প্রতিক অনেক অগ্নিকাণ্ডই পরিকল্পিত নাশকতা। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কেন্দ্র করেই এসব ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার কৌশল হিসেবেও এগুলো ব্যবহৃত হতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “অগ্নিসংযোগ কেবল সম্পদের ক্ষতি নয়, এটি মানব হত্যার শামিল একটি গুরুতর অপরাধ। আইন প্রয়োগের দুর্বলতার কারণেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। দায়ীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তি না দিলে এই প্রবণতা থামবে না।”

তদন্ত ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের তাগিদ

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের কাস্টমস হাউজে আগুনের সূত্রপাত হয়। ভবনটিতে প্রচুর দাহ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যদি ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম থাকত, এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না।”তিনি জানান, “তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। আগুনের কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।”