অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম। যিনি একাধারে একজন আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও ব্যাংকার। আইন অঙ্গনে পরিচিত সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে।এবার তৌফিকা করিমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করতে দুদকে আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ সুলতান মাহমুদ। সাবেক মন্ত্রীর যোগসাজশে অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ তৌফিকার বিরুদ্ধে। তার মতোই বিগত সরকারের মদদপুষ্ট নেতা-কর্মী, আমলাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনেই দুদকে জমা পড়ছে শত শত অভিযোগ। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দলটির নেতাকর্মী ও সরকার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাড়তে থাকে দুদকে। অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পর ১৩ আগস্ট থেকে সংস্থাটির অনুসন্ধান কার্যক্রমে গতি পায়। প্রতি কার্যদিবসে নতুন নতুন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে কমিশন। তলব, অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ ও বিভিন্ন দপ্তরে তথ্য চাওয়া শুরু করে।তবে গত ২৯ অক্টোবর মঈনুদ্দিন কমিশনের আকস্মিক পতনের পর থমকে গেছে এসব কার্যক্রম। ওইদিন হঠাৎ করেই দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ এবং সংস্থাটির দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক ও আছিয়া খাতুন পদত্যাগ করেন। ২০২১ সালের ৩ মার্চ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহকে দুদকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ করা দুই কমিশনারের মধ্যে জহুরুল হক একজন সাবেক জেলা জজ ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সাবেক চেয়ারম্যান। আর আছিয়া খাতুন সরকারের সাবেক সচিব ছিলেন।
পদত্যাগের পর দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের নাম প্রস্তাব করতে গত ১০ নভেম্বর বাছাই কমিটি গঠন করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।জানা গেছে, মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ কমিশনের পদত্যাগের পর নতুন কোনো অনুসন্ধান শুরু করেনি দুদক। বিভিন্ন অনুসন্ধানের ঘটনায় মাত্র তিনটি তলব ও একই সংখ্যক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত কোনো মামলা নেই।
এর আগের সপ্তাহে ২২ থেকে ২৯ অক্টোবরে তলবের ঘটনা ছিল ৫টি। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, জামালপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজমের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞাসহ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর বিরুদ্ধে ঋণ কেলেঙ্কারির মামলা হয়েছে।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের পদত্যাগের পর অনেকটাই থমকে গেছে দুদকের নিয়মিত কার্যক্রম। বিশেষ করে অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত, মামলার সিদ্ধান্ত, অভিযোগপত্রের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া ডাকযোগ ও কলসেন্টার যোগে আসা শত শত অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে সেগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি দুদক কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, কমিশনের এখতিয়ার ছাড়া গণমাধ্যমে কথা বলায় বিধিনিষেধ রয়েছে।
দ্রুত কমিশন গঠনের আহ্বান
দুদকের আইন অনুযায়ী, সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমিশনের। কমিশন শূন্য থাকলে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এর ফলে যত দ্রুত কমিশন গঠন হবে, তত দ্রুত স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারবে দুদক।
আর এ কারণেই দ্রুত কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের শতাধিক মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধানের কাজ চলমান রয়েছে। এমন একটি সময়ে শীর্ষ পর্যায়ে শূন্যতা দুদকের তদন্তসহ সব কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টি করবে। কেননা নতুন কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত নতুন করে কারও বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু ও তদন্ত বা মামলার সুযোগ থাকবে না। ফলে দ্রুত নতুন কমিশন গঠনের মাধ্যমে এ শূন্যতা পূরণ করা জরুরি।’
চলমান অনুসন্ধান ও তদন্ত চলবে
দুদক সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সমন্বয় সভা করেন। এতে শীর্ষ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চলমান অনুসন্ধান ও তদন্তের কার্যক্রম নিয়মিত চালিয়ে যাবেন কর্মকর্তারা। নতুন কমিশন না আসা পর্যন্ত আইন ও বিধি অনুযায়ী দুদকের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। জমা পড়া অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই চলবে। নতুন কমিশন এলেই সেগুলো সভায় তোলা হবে।
প্রতি কার্যদিবসে দুদকে ৩০০ অভিযোগ জমা
জানা গেছে, প্রতি কার্যদিবসেই দুদকে শতাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। এ ছাড়া দুদকের হটলাইন ১০৬ নম্বরে আরও শতাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। এছাড়া বিভিন্ন সমন্বিত জেলা কার্যালয়েও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দায়ের করেন। এই সংখ্যাটাও কম নয়। প্রতি কার্যদিবসেই অন্তত ৩০০ অভিযোগ জমা পড়ছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুদকের দায়ের করা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিম্ন আদালতে তিন হাজার ৫০০ মামলা বিচারাধীন। যার মধ্যে প্রায় তিন হাজার বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং হাইকোর্টের আদেশে প্রায় ৫০০ মামলার বিচার কাজ স্থগিত আছে। উচ্চ আদালতে ৭৩২টি রিট, ৯২৭টি ফৌজদারি বিবিধ মামলা, এক হাজার ২২৩টি ক্রিমিনাল আপিল ও ৬৮১টি ফৌজদারি রিভিশন মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। দুই শতাধিক অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান আছে। অনুসন্ধানের অপেক্ষায় আছে আরও অর্ধ শতাধিক ব্যক্তির ফাইল।