ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারী ২০২৫,
সময়: ০৭:৪০:৪০ PM

আক্রান্ত বয়স্ক ও শিশুরা বাড়ছে অসুখবিসুখ

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
30-12-2024 12:02:56 PM
আক্রান্ত বয়স্ক ও শিশুরা বাড়ছে অসুখবিসুখ

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসিন্দা আসিফ আদনান। বৃহস্পতিবার তিন বছরের কন্যা অনন্যাকে নিয়ে ছুটে যান আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। অনন্যা দুই দিন ধরে জ্বর, সর্দি-কাশি আর ঠান্ডায় আক্রান্ত। শুরুতে বিষয়টি নিয়ে বিচলিত না হলেও অবস্থার অবনতি হওয়ায় ঘরে বসে থাকতে পারেননি তিনি। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে ছুটে এসেছেন হাসপাতালে। বহির্বিভাগে চিকিৎসা শেষে কথা হয় আসিফ আদনানের সঙ্গে।তিনি বলেন, ছোট্ট বাচ্চা, কাশি দিতে কষ্ট হচ্ছে। জ্বরের তীব্রতা শুরুতে কম হলেও বুধবার রাত থেকে বেড়ে যায়। তাই বৃহস্পতিবার সকালেই হাসপাতালে নিয়ে আসি। তবে শঙ্কার কিছু নেই, চিকিৎসক জানিয়েছেন, অনন্যা মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত। শীতের সময়টায় ঠান্ডা থেকে নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সেইসঙ্গে ধুলাবালু থেকেও দূরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। ব্যবস্থাপত্রে কিছু ওষুধ লিখে দিলেও ভর্তি রাখতে হয়নি।বহির্বিভাগের সামনে আদনানদের মতো আরও বেশকিছু পরিবারের ভিড় চোখে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন নিকুঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সামিয়া-ইসমাইল আলী দম্পতি। ৬ বছরের একমাত্র ছেলে তন্ময়কে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। তন্ময় দুই বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। সেই যাত্রায় সুস্থ হলেও শীত মৌসুমে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। শ্বাসকষ্ট আর সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত তন্ময়।

সন্তানের বিষয়ে ইসমাইল আলী বলেন, নিউমোনিয়ার পর থেকে ছেলেটাকে নিয়ে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। প্রতি বছর শীতেই ঠান্ডা থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কয়েকদিন ধরে সামান্য সর্দি-কাশি দিচ্ছে। নেবুলাইজ করতে হচ্ছে। তবুও কমেনি, তাই শিশু হাসপাতালে ছুটে এসেছি।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে প্রতিদিন সেবা নিতে আসা জ্বর, ঠান্ডা ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, হাসপাতালটিতে নিউমোনিয়াসহ শীতকালীন রোগে আক্রান্ত রোগীর চাপ বেড়েছে। ৬৮১ শয্যার হাসপাতালটিতে নিউমোনিয়া রোগীদের জন্য বরাদ্দ সিটের সংখ্যা ১৯টি। শীতজনিত নানা রোগের জন্য দুই ওয়ার্ডে মোট শয্যা ৪০টি। হাসপাতালটিতে এখন গড়ে হাজারের ওপরে রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছে। সক্ষমতার অধিক শিশুকে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

এই দৃশ্য শুধু শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে নয়, চাপ বেড়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সর্দিজ্বরে আক্রান্ত রোগীর। বহির্বিভাগে প্রতিদিন যত রোগী আসছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশ শীতজনিত নানা রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ বয়স্ক ও শিশুরা আক্রান্ত। এর বাইরেও বিভিন্ন হাসপাতালে আসা সর্দিজ্বরে আক্রান্তদের অধিকাংশই শিশু।

মগবাজারের আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ ঘুরেও একই চিত্র দেখা যায়। মাতৃ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতালটির সুনাম থাকায় এ ধরনের রোগীর চাপও বেড়েছে। হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তা ইকবাল হোসাইন রুদ্র বলেন, শীতের শুরু থেকে জ্বর, সর্দি, নিউমোনিয়া ও শীতকালীন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগীর চাপ কিছুটা বেড়েছে। তবে এতে সেবা প্রক্রিয়ায় এখনো ব্যাহত হয়নি।

চিকিৎসকরা বলছেন, সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, টনসিলাইটিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, অ্যাজমা, চর্মরোগ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু থেকে বয়স্ক সব বয়সের মানুষ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর চাপ বেড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ নভেম্বর থেকে সম্প্রতি (এআরআই বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন) সর্দি-কাশি, গলাব্যথা ব্রঙ্কাইটিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস ও নিউমোনিয়ায় ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৪৩৭ জন। আক্রান্তের শীর্ষে রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ। সারা দেশে ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে একজনের, আক্রান্ত হয়েছে ৭৩ হাজারেরও বেশি।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান কামরুল  বলেন, শীতে সর্দি, কাশি, ব্রঙ্কিওলাইটিস ও অ্যাজমার প্রকোপ বেড়ে যায়। চর্মরোগ ও ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে যায়। পরিত্রাণের জন্য শিশুদের ঠান্ডা থেকে দূরে রাখতে হবে। গরম কাপড় পরিধান করাতে হবে। বিশুদ্ধ পানি খেতে হবে। নাক দিয়ে পানি এলে নরমাল স্যালাইন দিয়ে নাক পরিষ্কার করতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিহিস্টামিন ও অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, শ্বাসকষ্ট হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়াতে হবে।

তিনি বলেন, শীতের সময় ধুলাবালু ও বাতাসের শুষ্কতা কমে যায়। এ কারণে শিশুদের চর্মরোগের পাশাপাশি চুলকানি বেশি হয়। বাচ্চাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ও ধুলাবালু থেকে দূরে রাখতে হবে। এরপরও কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ঋতু পরিবর্তন স্বাভাবিক ঘটনা। শীত মৌসুমে নানা ধরনের রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। এ সময়ে সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ফ্লোর অধিক সংক্রমণ ঘটে। সব বয়সীরা আক্রান্তের ঝুঁকিতে থাকেন। তবে বেশি ভোগেন শিশু ও বয়স্করা। শীতকালে বয়স্ক লোকদের অ্যাজমা, গলাব্যাথা, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টনসিল ও গিরায় গিরায় ব্যথা হয়। তাদের দেখাশোনা করা ব্যক্তিদের অধিক সতর্ক হতে হবে। বয়স্ক ও শিশুদের শীতে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। শিশুদের শীতের পোশাক পরিধান করাতে হবে। সামান্য অবহেলার কারণে শিশুদের মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। শীতজনিত রোগে বেশি শারীরিক অসুস্থতা বাড়তে থাকলে শিশুবিষয়ক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।