ঢাকা, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫,
সময়: ১১:৪৬:০৪ AM

পুলিশের স্বনামে-বেনামে শত শত অটোরিকশা

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
08-07-2025 11:46:04 AM
পুলিশের স্বনামে-বেনামে শত শত অটোরিকশা

রাজধানী ঢাকার মতো চট্টগ্রাম মহানগরীতেও সরকারিভাবে ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নিয়ে চলে। ‘চট্ট-মেট্রো’ ছাড়া ‘চট্টগ্রাম’ সিরিয়ালের গাড়ি নগরীতে চলার অনুমতি নেই। এটা সাধারণত সিটির বাইরে গ্রামাঞ্চলে চলে। কিন্তু ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের স্বনামে-বেনামে জেলায় নিবন্ধিত অটোরিকশা ভাড়ায় চলছে নগরীতে। বেশি লাভের আশায় পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে নগরীতে চলে বাড়াচ্ছে যানজট। সরেজমিনে অনুসন্ধানে এমন বেশ কয়েকটি তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ‘নগরীর দেওয়ান হাট এলাকায় যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিল চট্টগ্রাম-থ-১১-৬৮৭২ নম্বরের সিএনজিচালিতচালিত অটোরিকশা। এসময় কথা হলে গাড়ির চালক নিজের নাম আকবর আলী দাবি করে বলেন, ‘গাড়িটি কনস্টেবল রাজ্জাকের। উনি বন্দর এলাকায় ডিউটি করেন। আমি এক বছর ধরে চালাই। প্রতিদিন ৫শ টাকা ভাড়া দেই।’

 

গাড়িতে লেখা মোবাইল নম্বরে কথা হয় কনস্টেবল রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এটি আমার গাড়ি। ফাঁকে-ফোঁকে চলে।’ চৌমুহনী এলাকায় দেখা যায় ‘চট্টগ্রাম-থ-১৪-১৯৯৫’ নম্বরের অটোরিকশা। চালক বললেন- ‘এটি সার্জেন্ট নাঈমুল ইসলামের নিজের গাড়ি। প্রতিদিন ৭শ টাকা ভাড়া দেই।’ রাস্তায় চলাচলে অন্য সার্জেন্টরা আটকান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় আটকায়। টো-ও (আটক) করে।’ অটোরিকশার পেছনে নাঈম পরিবহন লেখা রয়েছে। গাড়ির নিবন্ধন স্মার্টকার্ডেও সার্জেন্ট নাঈমের পুলিশের পোশাক পরিহিত ছবি। তার নিজের নামে নিবন্ধিত।এ ব্যাপারে সার্জেন্ট নাঈমুল ইসলাম  বলেন, ‘গাড়িটি আমার নিজের নামে নিবন্ধিত। আগে গ্রামে চলতো। এখন আমার বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়।’

চৌমুহনী এলাকায় দেখা মেলে ‘চট্টগ্রাম-থ-১৪-৫১১৯’ নম্বরের আরেকটি অটোরিকশার। গাড়ির চালক শাহপরান বলেন, ‘গাড়িটি সার্জেন্ট মিলন স্যারের। আমি এক সপ্তাহ ধরে গাড়িটি চালাই। দিনে ৮শ টাকা ভাড়া দেই।’ সার্জেন্ট মিলন ডিউটি কোথায় করেন জানতে চাইলে শাহপরান বলেন, ‘ডিউটি শহরেই করেন। কোন জায়গায় করেন তা জানি না।’রোববার নগরীর বিআরটিসি ফলমন্ডি এলাকায় দেখা যায় ‘চট্টগ্রাম-থ-১৪-২০৪৫’ নম্বরের সিএনজিচালিত অটোরিকশা যাত্রী নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। চালক বললেন এটি সার্জেন্ট জসিম স্যারের গাড়ি। গাড়িতে লেখা নম্বরে ফোন করা হলে সার্জেন্ট জসিম উদ্দীন বলেন, ‘১৪-২০৪৫ সিরিয়ালের সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি আমার। আমার বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য গাড়িটি ব্যবহার করা হয়।’দুপুরে নগরীর ব্যস্ততম টাইগারপাস এলাকা বীরদর্পে পার হয়ে যাচ্ছিল ‘চট্টগ্রাম-১৪-৯৯৭১’ নম্বরের অটোরিকশাটি। কথা হলে চালক সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘এটি সার্জেন্ট তৌফিক স্যারের গাড়ি।’

এর আগে সকালে চট্টেশ্বরী রোডে দেখা যায়, ‘চট্টগ্রাম-থ-১৫-০৭৫৫’ সিএনজিচালিত অটোরিকশা যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে। কথা হলে চালক মো. হাসান বলেন, এটি টিআই উত্তম স্যারের গাড়ি। গাড়িতে লেখা নম্বরে ফোন করলেও টিআই উত্তর দেবনাথ রিসিভ করেননি।’বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) কাজীর দেউড়ি এলাকায় যাত্রী নামাচ্ছিলেন ‘চট্টগ্রাম-থ-১৩-৫৬০৫’। কথা হলে গাড়ির চালক বলেন, ‘গাড়িটি অপু স্যারের। উনি এখন আগ্রাবাদে ডিউটি করেন। সার্জেন্টের চেয়ে একটু ওপরের র‌্যাঙ্কের। দিনে ৭শ টাকা ভাড়া দেই।’ বুধবার (৩১ জানুয়ারি) রাস্তায় চট্টগ্রাম সিএনজিচালিত অটোরিকশা ধরপাকড়ের বিষয়ে জানতে চাইলে চালক বলেন, ‘বুধবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রাস্তায় না নামতে বলেছিলেন স্যার।’৩১ জানুয়ারি সকাল থেকে নগরীতে ‘চট্টগ্রাম’ সিএনজিচালিত অটোরিকশা আটক অভিযান শুরু করে সিএমপি। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া ওইদিন দুপুর ১২টায় প্রতিবেদককে বলেন, ‘আজ (বুধবার) সকাল ১০টা থেকে প্রথম এক ঘণ্টায় ১০৫টি চট্টগ্রাম সিএনজিচালিত অটোরিকশা আটক করা হয়েছে।’

 

মূলত সিএমপি হেড কোয়ার্টার থেকে যখন অবৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশনা দেওয়া হয়, তখন নগরীতে নিজের নামে কিংবা মাসোহারায় চট্টগ্রাম সিএনজিচালিত অটোরিকশা পরিচালনাকারী সার্জেন্টরা তাদের নির্দিষ্ট গাড়ির চালকদের রাস্তায় না নামার তথ্য জানিয়ে দেন। ‘চট্টগ্রাম-থ-১৩-৫৬০৫’ নম্বরের অটোরিকশাটির চালকের বক্তব্যে এর সত্যতা মেলে।গাড়িটির গায়ে লেখা নম্বরে কথা হয় সার্জেন্ট অপু দাশের সঙ্গে। প্রথমে গাড়িটি নিজের স্বীকার করতে চাইলেও পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বলেন, ‘গাড়িটি আমি আগেই বিক্রি করে দিয়েছি।’ গাড়িতে লেখা নম্বরের বিষয়ে বলেন, ‘হয়তো আমার নাম বিক্রি করে কেউ চালাচ্ছে।’

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ ধরনের ‘চট্টগ্রাম’ নিবন্ধিত এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক বলেন, নগরীতে হাজারের অধিক ‘চট্টগ্রাম’ সিএনজিচালিত অটোরিকশা নগরীতে চলাচল করে। প্রত্যেকটি গাড়ির জন্য মাসিক তিন থেকে চার হাজার টাকা মাসোহারা দিতে হয়। ট্রাফিক সার্জেন্ট, সাংবাদিকদের নামে চলাচল করে এসব বাহন। নগরীর বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ রুটেও এসব অটোরিকশা রুট বানিয়ে চলাচল করে। থানা পুলিশ ও ট্রাফিককে ম্যানেজ করে শ্রমিক সিন্ডিকেট এসব গাড়ি পরিচালনা করেন।

 

চট্টগ্রাম সাধারণ সিএনজিচালিত অটোরিকশা সাধারণ মালিক ঐক্য পরিষদ সভাপতি মো. মহিউদ্দিন  বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১৫ বছরের পুরোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো ভেঙে নতুন করে অটোরিকশা পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। অথচ জেলায় নিবন্ধিত কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙা হয়নি। জেলার সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো (লোহার নিরাপত্তাবেষ্টনী) লাগিয়ে মেট্রোতে নিবন্ধিত অটোরিকশার মতো চলাচল করছে। এতে নগরীতে একদিকে গাড়ির চাপ বাড়ছে, যানজটও বাড়ছে।তিনি বলেন, ‘জেলায় নিবন্ধিত গাড়িগুলো অবৈধভাবে নগরীতে চলাচল করার কারণে মেট্রোর গাড়িগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার জেলায় নিবন্ধিত গাড়িগুলোর হালনাগাদ তথ্য সিএমপিতে থাকে না। ওইসব গাড়িতে চুরি-ছিনতাই হলে অপরাধীদের চিহ্নিত করাও দুরূহ হয়ে যায়।’

 

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া  বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলা থেকে শহরে প্রবেশের জন্য বেশ কয়েকটি পকেট রয়েছে। এসব পকেটে চট্টগ্রাম নিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোগুলো আসে। এসব অটোরিকশা যাতে শহরে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য নগর ট্রাফিকের নজরদারি থাকে। নগরীতে পাওয়া গেছে এসব অটোরিকশা আটক, টো করা হয়। কিন্তু সিএমপিতে গাড়ি ডাম্পিং করার জায়গা সংকট রয়েছে। এতে চাইলেও অতিরিক্ত গাড়ি টো করে এনে রাখা যায় না।তিনি বলেন, আমরা চট্টগ্রাম নিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে যখন অভিযান শুরু করি, তখন এসব গাড়ি নগরীর গলির রাস্তাগুলোতে ঢুকে যায়। কারণ এসব গাড়ি যারা চালান, তাদের একটি চেইন রয়েছে। অভিযান শুরু করলেই তারা খবর পেয়ে যায়। এখানেও সিএমপির যে জনবল তা, দিয়ে ছোট রাস্তা কিংবা গলির মধ্যে চলা গাড়িগুলোকে নিয়ন্ত্রণ কিংবা আইনের আওতায় আনা দুরূহ।তবে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মাসোহারায় নগরীর অবৈধ গাড়ি চালানোর বিষয়ে তিনি বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পুলিশ একটি সুশৃংখল বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্যরা পেশাদারত্ব নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।