
মহানগর টরন্টো। প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন মানুষ—কেউ শিক্ষার্থী, কেউ শরণার্থী, কেউ নতুন অভিবাসী—এই শহরে পা রাখেন এক রঙিন স্বপ্ন নিয়ে। টরন্টোর নাম শুনেই তাদের মনে হয়, হয়তো এখানেই গড়ে উঠবে তাদের নতুন জীবন, যেখানে থাকবে নিরাপত্তা, সম্মান, আর সম্ভাবনার ঝলমলে সকাল। তারা স্বপ্ন দেখেন একটি ছোট্ট ঘর, যেখানে থাকবে একটু প্রশান্তি, একটু গোপনীয়তা, আর কিছুটা নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার। কিন্তু বিমানবন্দরের কাচের দরজা পেরোনোর পর সেই স্বপ্নের সঙ্গে ধাক্কা লাগে এক নির্মম বাস্তবতার। টরন্টোর স্কারবোরো কিংবা ইষ্ট ইয়র্ক মানে যেনো একটি 'লোকেশন অ্যাডভান্টেজ'। এখানেই রয়েছে কলেজ, চাকরি, মসজিদ, বাঙালি দোকান আর আত্মীয়-পরিজনের সাহচর্য। সবচেয়ে বড় কথা—এখানে রয়েছে কমিউনিটির ছায়া। তাই নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট, রিফিউজি কিংবা স্টুডেন্টরা চায় এ এলাকাতেই থাকতে। আর এই চাওয়াকে পুঁজি করেই সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু বাড়িওয়ালা, যারা নিজেরাই একসময় ছিলেন নতুন।
একেকটি বাসা বাইরে থেকে দেখা যায় দালান কিন্তু ভেতরের অবস্থা বস্তির চাইতে খারাপ। বেসমেন্টের প্রায় ঘরগুলো জানালাহীন, ফাঙ্গাসে ভর্তি, বাতাস নেই। সেখানে ৮/১০ জন থাকে। একটি ওয়াশরুমে লাইন পড়ে ভোর থেকে। রান্নাঘরে ইঁদুরের দৌড়, খাবার টেবিল তেলাপোকা, বিছানায় ছারপোকার অত্যাচার। মালিককে বলা হলে উত্তর আসে—''যে ভাড়া দেন তাতে একটু ম্যানেজ করে চলতে হবে। ভাল না লাগলে অন্য জায়গায় বাসা দেখেন''। এ উত্তর শুনে ভাড়াটিয়ারা চুপ হয়ে যায়। তারা নিরুপায়।
এ শহরে অনেক বাড়ির মালিক বাংলাদেশি। নতুন লোকেরা দেশি মানুষের বাড়িতে বেশি নিরাপদ বোধ করে। এদের কারো নাম আব্দুর রহমান, কারো এনায়েতুল করিম। কেউ এসেছেন ৯০-র দশকে, কেউ বা আরও পরে। আজ তারা সিটিজেন। এখন তারা একেকজন মাল্টি-প্রপার্টি ওনার। অধিক অর্থ কামানোর আশায় নিজ দেশের লোকের প্রতি অবিচার করতে তারা কুন্ঠিত হয় না।
এক একটি রুমে থাকে চারজন—দু’জন বিছানায়, দু’জন মেঝেতে। বাথরুমে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কারো কারো রাতে ঘুমাতে গিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিং-এ। কারো হাঁপানি বেড়ে যায় ফাঙ্গাসে। কেউ অভিযোগ করার সাহস পায় না। কারণ, বর্তমান বাজারে বাসা পাওয়া মুশকিল।
এই নির্মমতার একটি উদাহরণ হলো ইস্টইয়র্কের মেহরাবের গল্প। ইস্টইয়র্কের ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউর একটি ঘরে থাকেন ২২ বছরের এ যুবক। তিনি রিফিউজি হিসেবে এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। মাসে ৮০০ ডলার দেন একটা জানালাহীন ছোট ঘরে যেখানে থাকেন আরও তিনজন। অবর্ণনীয় কষ্ট যাকে বলে। ঋণ করে দুইমাসের ভাড়া এডভান্স দিতে হয়েছে। মালিকের ব্যবহার একেবারে কসাইয়ের মতো।
এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যে অতি সম্প্রতি কিছু ঘটনাকে ঘিরে কানাডিয়ান প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। স্কারবোরোর এক অসাধু মালিক আব্দুর রহমান। এক সময়ের নির্মাণ শ্রমিক, এখন পাঁচটি বাড়ির মালিক। তার বাড়ির বেসমেন্টে ১২ জন রিফিউজিকে গাদাগাদি করে রাখতেন। ঘরে আলো ছিল না, ছিল না ঠিকমতো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থাও। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। তাকে বারবার বলার পরও তার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের জবাব এবং অসম্মানজনক আচরণে অন্যরা কিছু না বললেও একজন ভয়-ডর ভুলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি প্রমাণ হিসেবে বাসার ভিডিও, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ছবি এবং মালিকের হুমকির অডিও রেকর্ডিং জমা দেন।
তথ্য অনুযায়ী, টরন্টো ফায়ার সার্ভিস ও পাবলিক হেলথ ইন্সপেক্টর যৌথভাবে হানা দেন আব্দুর রহমানের বাড়িতে। তারা আবিষ্কার করেন, বেসমেন্টে বাস করার কোনো অনুমতি ছিল না, কিন্তু সেখানে গাদাগাদি করে থাকছেন ১২ জন। বাতাস চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জানালা ছিল না, ছিল না ধোঁয়া শনাক্তকারী বা আগুন থেকে পালানোর বিকল্প পথ।
এই তদন্তের ভিত্তিতে Toronto Fire Code এবং Public Health Act লঙ্ঘনের প্রমাণে আব্দুর রহমানকে $৫০,০০০ ডলার প্রশাসনিক জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া ভাড়াটিয়াদেরকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে $২,০০০ করে আদায় করে দেয়া হয়। তার বাড়ির রেন্টাল লাইসেন্স বাতিল করে দেয় সিটি অথরিটি এবং পরবর্তী দুই বছরের জন্য তাকে ভাড়াটে রাখার অনুমতিও স্থগিত করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ, Public Health Act লঙ্ঘনের কারণে তার একাধিক বাড়িতে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করা হয়।
অভিযোগ উঠে ডাউনটাউনের বাড়ির মালিক এনায়েতুল করিমের বিরুদ্ধে। তিনি তার তিনটি বাড়িতে নতুন আসা বাংলাদেশি রিফিউজি ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করলেও তাদের কোনো রশিদ দিতেন না। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিটি কর্মকর্তারা তদন্তে আসেন। অতিরিক্ত বাসিন্দা, অনুমোদনবিহীন বেসমেন্ট ভাড়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অগ্নিসুরক্ষার অভাব সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে $১২০,০০০ ডলার জরিমানা আরোপ করে Municipal Licensing Tribunal।
উল্লেখ্য, Toronto Municipal Code-এর অধীনে অতিরিক্ত ভাড়াটিয়া রাখার জন্য মালিকদের বিরুদ্ধে $১০০,০০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করা হয়, এমনকি লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হতে পারে। Ontario Building Code Act অনুযায়ী বেসমেন্টে অবৈধ বসবাসের শাস্তি ধার্য হয় $৫০,০০০ জরিমানা, যেখানে প্রতিদিন $৫,০০০ করে অতিরিক্ত জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। Public Health Act অনুযায়ী ইঁদুর বা ছারপোকার উপদ্রবের কারণে বাড়ি সিল করা হয় এবং $২৫,০০০ পর্যন্ত জরিমানা করা হয়। আর যদি কোনো মালিক Residential Tenancies Act অনুযায়ী বেআইনিভাবে অতিরিক্ত ডিপোজিট নেন, তবে তার বিরুদ্ধে ডিপোজিটের দ্বিগুণ ফেরতসহ $২৫,০০০ জরিমানা ধার্য করা হতে পারে।
২০২৫ সালে টরন্টো সিটি কর্তৃপক্ষ নতুন একটি হাউজিং টাস্ক ফোর্স গঠন করে, যারা প্রতি ছয় মাস অন্তর র্যান্ডম চেক করে থাকে ভাড়াবাড়িগুলোয়। এছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যারা ভয়ে অভিযোগ করতে পারেন না, তাদের জন্য গোপন হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে—৪১৬-৮০৮-২২২২ নম্বরে কল করে অনুবাদকের সহায়তায় অভিযোগ জানানো যায়। মোবাইল ফোনে মালিকের হুমকির অডিও-ভিডিও রেকর্ড রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি বাড়ির নোংরা অবস্থা, ইঁদুর বা ভাঙা জানালার ছবি তুলেও জমা দেওয়া যায়। প্রতিবেশীদের সাক্ষী হিসেবে রাখা হলে অভিযোগের ভিত্তি আরও দৃঢ় হয়।
এই আইনসমূহ শুধু নিয়ম নয়, বরং অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীদের ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের রক্ষাকবচ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তথ্য না জানার কারণে অনেকেই এই আইনগত সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হন। তাই, এসব বিধান সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়াই এখন সময়ের দাবি। এই শহরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক, পেশাজীবীসহ সকল সংগঠন এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
এটি শুধু একটি আবাসনের গল্প নয়, এটি বেঁচে থাকার লড়াই। যারা এসেছে নিরাপত্তা আর সম্মানের আশায়, তাদের বুকে পেরেক ঠুকে কেউ কেউ বানাচ্ছে বিলাসবহুল জীবন। টরন্টোর বুকে এখন সময় এসেছে—এই ‘ছায়াঘর’গুলোর ভিতর আলো প্রবেশ করানোর।
দ্রষ্টব্য (Footnote):
আইনি সীমাবদ্ধতা ও নৈতিক কারণে এ প্রতিবেদনের সকল নাম ও সংযুক্ত ছবি কল্পিত।
(সংগ্রহিত )