ঢাকা, রবিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৫,
সময়: ০১:৫৪:১৫ PM

দলে ফেরার হিড়িক:দুঃসময়ে ত্যাগ, সুসময়ে প্রত্যাবর্তন

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
09-11-2025 10:43:56 AM
দলে ফেরার হিড়িক:দুঃসময়ে ত্যাগ, সুসময়ে প্রত্যাবর্তন

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিল বিএনপির জন্য সবচেয়ে সুসময়। তখন দলে ছিল প্রভাবশালী বহু নেতা। কিন্তু ২০০৭ সালের ১/১১ সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দলের অবস্থা অবনতির দিকে যেতে থাকে। সেই সময় থেকেই দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা ‘সংস্কারপন্থি’ নামে পরিচিত হয়ে বিএনপির বিরোধিতায় নামেন।

পরবর্তীতে শেখ হাসিনার দীর্ঘ মেয়াদি শাসনে বিএনপির জন্য আসে আরও কঠিন সময়। বিশেষ করে গত এক দশকে দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন— কেউ রাজনীতি থেকে নির্বাসনে যান, কেউবা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেন। কেউ আবার নতুন দল গড়ে নির্বাচনে অংশ নেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ইতোমধ্যেই মারা গেছেন।

শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন বাস্তবতা

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়, শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা দেশত্যাগ করেন। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির দুঃসময়ে দল ছেড়ে যাওয়া অনেক নেতা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। বিদেশফেরত এসব নেতার পাশাপাশি দেশে থাকা প্রাক্তন নেতারাও দলে ফেরার চেষ্টায় সক্রিয় হয়েছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “বহিষ্কৃত ও পদত্যাগ করা অনেক নেতা গণসংযোগ করছেন, তবে তাদের দলে ফেরানোর বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।”
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “বিএনপির হাইকমান্ড যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তা বাস্তবায়ন করব।”

তৃণমূল পর্যায়ের বহু নেতা-কর্মী মনে করেন, দুঃসময়ে যারা দল ত্যাগ করেছিলেন, এখন সুসময়ে তাদের ফেরার চেষ্টা দলের প্রতি কমিটমেন্টের ঘাটতি প্রকাশ করে।


মোসাদ্দেক আলী ফালু: ফেরার অপেক্ষায়

বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব মোসাদ্দেক আলী ফালু ২০১৭ সালে দেশ ত্যাগ করেন। সাত বছর পর, ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট তিনি দেশে ফেরেন এবং সরাসরি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কয়েকটি মামলায় খালাস পেলেও এখনো দলে ফেরার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি। দলের ভেতরে আলোচনা আছে— ফালু এখন আগের মতো প্রভাব পাচ্ছেন না।


এম. মোরশেদ খান: রাজনীতি থেকে অবসর

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এম. মোরশেদ খান ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর দল থেকে পদত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন। বিএনপি নেতাদের মতে, মূলত ব্যবসা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ এবং রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ অবসর নিয়েছেন।


ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর: দুই কূল হারানো নেতা

বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ২০২৩ সালের নভেম্বর আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে জয়লাভ করেন। শেখ হাসিনার পতনের পর সংসদ ভেঙে গেলে তিনি সাংসদ পদ হারান। বর্তমানে হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। বিএনপির নেতারা বলছেন, ক্ষমতার লোভ ও মামলা থেকে রক্ষা পেতেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন।


শমসের মবিন চৌধুরী: রাজনীতি থেকে নীরব অবসর

সাবেক কূটনীতিক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ২০১৫ সালে দল ছাড়েন। পরবর্তীতে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও জামানত হারান। বর্তমানে তিনি রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ অবসর নিয়ে পারিবারিক জীবনে মনোযোগী।


মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: রাজনীতির আড়ালে

কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম দীর্ঘদিন বিএনপির সহযোগী ছিলেন। ২০২৩ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেন ও জয়ী হন। আওয়ামী লীগ পতনের পর তিনি সাংসদ পদ হারান। বর্তমানে তিনি নীরব জীবনযাপন করছেন, তবে ভবিষ্যতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।


আলী আসগর লবী ও মিজানুর রহমান সিনহা: দলে ফেরা বিতর্ক

দীর্ঘ বিরতির পর রাজনীতিতে ফিরেছেন সাবেক এমপি আলী আসগর লবী ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মিজানুর রহমান সিনহা। লবী খুলনা-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন, আর সিনহা মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হয়েছেন। তবে তাদের প্রত্যাবর্তনে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে— তারা মনে করছেন, দুঃসময়ে পাশে না থাকা নেতারা এখন সুসময়ের সুযোগ নিচ্ছেন।


মনজুর আলম: রাজনীতি থেকে ব্যবসায়

চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম ২০১০ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। ২০১৫ সালে রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেও ২০১৬ সালে আবার আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত এবং রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন।


বিএনএম ও অন্যান্য প্রাক্তন নেতারা

বিএনপি থেকে বেরিয়ে নতুন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) গঠন করেন সাবেক এমপি শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ও আব্দুর রহমান। নির্বাচনে জামানত হারানোর পর এখন তারা প্রায় নিস্ক্রিয়।

অন্যদিকে, কর্নেল (অব.) শাহজাহান মিয়া, মহিউদ্দিন খান মোহন, সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময়ে দল ত্যাগ করে এখন নীরব জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ আবার শেখ হাসিনার আমলের ‘ডামি’ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বহিষ্কৃত হয়েছেন।


মূল্যায়নের পালা

বিএনপির ভেতরে এখন আলোচনা— যারা দুঃসময়ে দলের পাশে ছিলেন, তারাই এবার অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। তৃণমূলের ত্যাগী নেতাদের মধ্যে আছেন খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জু, মিজানুর রহমান সিনহা ও আলী আসগর লবী। বিশ্লেষকদের মতে, যদি অনেক প্রাক্তন নেতা ২০২৪ সালের ‘ডামি’ নির্বাচনে অংশ না নিতেন, তাহলে তারাও হয়তো আজ বিএনপির মনোনয়ন পেতেন।


সারসংক্ষেপ:
বিএনপির দীর্ঘ রাজনৈতিক দুঃসময়ের পর এখন যখন দলে নতুন প্রাণের সঞ্চার, তখন পুরোনো অনেক নেতার ফিরে আসা নিয়ে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ দেখছেন পুনর্মিলনের আশাবাদ, কেউ দেখছেন সুযোগসন্ধানী রাজনীতির পুনরাবৃত্তি।