ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ঐক্য ও বাড়তি তৎপরতা। এই ঐক্য শুধু রাজনৈতিক আলোচনায় নতুন গতি এনেই থেমে নেই—এটি সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে বিএনপির নির্বাচনি কৌশল ও অঙ্কে। কারণ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সক্রিয় এবং সংগঠিতভাবে নির্বাচনমুখী হয়েছে ইসলামি ঘরানার দলগুলো।বর্তমানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি—এই আটটিরও বেশি ইসলামি দল দেশের প্রায় তিনশ আসনের প্রায় প্রতিটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার ঘোষণা দিয়েছে। স্বভাবতই এসব দলের সক্রিয়তা বিএনপির সম্ভাব্য ভোটব্যাংকে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
ইসলামি দলগুলো বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী বেশ কয়েকটি অঞ্চলে শক্তিশালী সাংগঠনিক অবস্থান গড়ে তুলেছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাদের নেতারা প্রত্যাশার চেয়েও ভালো নির্বাচনি ফল অর্জনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ফলে ঐতিহ্যগতভাবে একই ভোটব্যাংকে নির্ভরশীল বিএনপির জন্য এটি নিঃসন্দেহে কঠিন সমীকরণ।
বিএনপির পাল্টা কৌশল
তবে পরিস্থিতি বুঝে বিএনপিও পিছিয়ে নেই। দলটি ইতোমধ্যে দুইশ থেকে আড়াইশ আসন লক্ষ্য করে বিভিন্ন ইসলামি দল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং প্রভাবশালী আলেম-ওলামাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। বিশেষ করে যে সব অঞ্চলে ইসলামি দলগুলো শক্তিশালী—সেসব এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ের সমন্বয় প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা হয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, নির্বাচনে জয়ের পথে তাদের গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ইসলামি ভোটের বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজন। তাই শুরু থেকেই তারা ধর্মীয় ঘরানার ভোট অন্য দিকে সরে যাওয়ার ঝুঁকি কমাতে চেষ্টা চালাচ্ছে। সবকিছু অনুকূলে থাকলে এবং ভোটের মাঠে সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা গেলে বিএনপি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পেতে পারে বলে তারা মনে করেন।
ইসলামি দলের ভোটে সম্ভাব্য পরিবর্তন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামায়াত ইসলামী যদি অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন পায়, তাহলে তারা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বহুগুণ বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছাতে পারে। কারণ জামায়াতের রয়েছে দীর্ঘদিনের সংগঠিত কাঠামো, গ্রাম পর্যায়ে নিবেদিত কর্মী এবং একটি নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক।
অন্যদিকে যদি ইসলামি দলগুলোর ভোট ভাগাভাগি হয়ে যায়—অর্থাৎ একই আসনে একাধিক ইসলামি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে—সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি জামায়াতেরই। বিশ্লেষকদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে জামায়াত কমপক্ষে ৫০টির বেশি আসনে খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে—হাজার থেকে কয়েকশ ভোটেও—পরাজিত হতে পারে।
ফলে ইসলামি ভোট এককভাবে কার দিকে যাবে—এ প্রশ্নটিই এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নির্বাচনি ফলাফলে সম্ভাব্য চিত্র
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন যদি পুরোপুরি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে একেক দলের আসন সংখ্যা যতই হোক না কেন, পরবর্তী সরকার গঠনের সমীকরণে ‘জাতীয় সরকার’ বা জোটভিত্তিক সরকার গঠনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ তিনটি প্রধান ভোটধারার (ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি) ভেতরে অন্তর্গত বিভাজন ও প্রতিযোগিতা যেকোনো দলকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার বাইরে ঠেলে দিতে পারে।
তবে অন্যদিকে যদি কোনো দল এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে—যেমনটা অতীতে একাধিকবার দেখা গেছে—তাহলে সেই দলই সরকার গঠন করবে।
উপসংহার
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ার পাশাপাশি সমীকরণও আরও জটিল হয়ে উঠছে। বিএনপির সামনে যেমন ইসলামি দলগুলোর ঐক্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, তেমনি ইসলামি দলগুলোর মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সমন্বয় বা মতপার্থক্যও তাদের ভবিষ্যৎ ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এবারের নির্বাচন তাই কেবল দুই-একটি বড় দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়—বরং সমগ্র রাজনৈতিক অঙ্গনের জটিল ও বহুমাত্রিক শক্তির লড়াই।