জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নতুন করে নানা বিষয় বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে প্রচার–প্রচারণা। পাশাপাশি ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ বাড়ানো, দুটি ব্যালট প্রস্তুত, অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ—সব মিলিয়ে ইসিকে স্বল্প সময়ে বিরাট কর্মযজ্ঞ সামলাতে হবে।
প্রচারণাই বড় চ্যালেঞ্জ
সংশ্লিষ্টদের মতে, জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীরা নিজ নিজ প্রতীকে ব্যাপক প্রচারণা চালালেও গণভোট বিষয়ে তাঁদের তেমন আগ্রহ থাকে না। তাই গণভোটের প্রচারের দায়িত্ব মূলত সরকারের কাঁধে পড়ে। এতে গণভোটে জনগণের সাড়া নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন,
“একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ইসির জন্য চ্যালেঞ্জিং। রোডম্যাপ বদলাতে হবে, প্রস্তুতিও বাড়াতে হবে। দুটি ব্যালট, দুটি বাক্স, আলাদা গণনাকারী দল—সব মিলিয়ে কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন, গণভোটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রচারণা। রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট—দুই ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রচারণা চালাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন, বিশেষ করে নিরক্ষর ভোটারদের বুঝিয়ে তোলার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
একই দিনে দুই ভোটে ব্যয় বাড়বে
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রায় ৩৪ বছর পর দেশের প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি গণভোট আয়োজন করতে গিয়ে ভোটকেন্দ্র, ভোটকক্ষ, কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম—সব ক্ষেত্রেই বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হবে। এতে ব্যয় ২০ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী জানান,
“একই দিনে দুই ভোট আয়োজনের অন্যতম কারণ ব্যয় কমানো। তবে তবুও গণভোটের কারণে ১০–১৫ শতাংশ বাড়তি খরচ লাগবে।”
তিনি বলেন, ভোটগ্রহণ ও গণনা—দুই ক্ষেত্রেই আলাদা দল লাগবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একই কাঠামোতে কাজ চালাতে পারলেও ভোটের চাপ সামলাতে ভোটকক্ষ বাড়াতে হবে।
চারটি বিষয়ের ওপর এক প্রশ্নে গণভোট
অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চারটি সংস্কার-প্রস্তাব একত্রে একটি প্রশ্নে ভোটের জন্য উপস্থাপন করা হবে। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের ফেসবুকে প্রস্তাবিত প্রশ্ন প্রকাশ করা হয়।
চারটি প্রস্তাব হলো—
ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদের প্রক্রিয়ায় পুনর্গঠন।
খ. আগামী সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা—জাতীয় নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ গঠন এবং সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা।
গ. জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে গৃহীত ৩০টি সংস্কার বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলোর বাধ্যবাধকতা।
ঘ. জুলাই সনদের অন্যান্য সংস্কার দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন মনে করেন, চারটি বিষয় এক প্রশ্নে রাখায় ভোটাররা বিভ্রান্ত হতে পারেন। সময়ও স্বল্প, তাই সচেতনতা বাড়ানো ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
দ্বিগুণ প্রস্তুতি, বেশি সময় লাগবে গণনায়
ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে। প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটার এবং বিদেশে আরও প্রায় এক লাখ ভোটারকে বিবেচনায় রেখে দুই ধরনের ব্যালট ছাপার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি।
দেশজুড়ে ৪৩ হাজার কেন্দ্র, ২ লাখ ৪৫ হাজার ভোটকক্ষ, ৯–১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এবং ৭–৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবেন।
জেসমিন টুলী বলেন,
“ব্যালট গণনায় দুই দল লাগবে—একটি জাতীয় নির্বাচনের ভোট গণনা করবে, অন্যটি হ্যাঁ–না ভোট। এতে সময় অনেক বেশি লাগবে।”
ফেব্রুয়ারির ছোট দিন হওয়ায় ভোটের সময় বাড়ানোর সুযোগ নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সামগ্রিক চ্যালেঞ্জ
একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন—ইসির জন্য বিরল ও জটিল চ্যালেঞ্জ। প্রচারণা, প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম, গণনা—সব ক্ষেত্রেই বাড়তি চাপ সামলাতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন হবে।