ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫,
সময়: ০৪:২১:২১ PM

দেশের স্বাস্থ্যখাতে অনিয়মে ভয়াবহ চিত্র

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
14-10-2025 01:19:04 PM
দেশের স্বাস্থ্যখাতে অনিয়মে ভয়াবহ চিত্র

দেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং দায়িত্বে অবহেলা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগে উঠে এসেছে একের পর এক ভয়াবহ অনিয়মের তথ্য।সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) চিকিৎসার জন্য মাকে নিয়ে যাওয়া এক শিক্ষার্থী, রাতুল চৌধুরীর ওপর অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগে নতুন করে আলোচনায় আসে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা।রাতুল তার ফেসবুক পোস্টে জানান, ৯ অক্টোবর হাসপাতালে অনিয়মের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে আনসার সদস্যরা তাকে জোরপূর্বক টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে লাঠি ও রড দিয়ে এলোপাথাড়ি মারধর করেন। এক পর্যায়ে তাকে উলঙ্গ করে পেটানো হয় এবং নির্যাতনের ফলে তিনি জ্ঞান হারান। তার মা প্রশাসনিক ভবনের বাইরে চিৎকার করলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করে রাতুল হাসপাতালে নেই এবং তিনি নাকি গণপিটুনিতে মারা গেছেন।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, ঘটনার দিন সকালে হাসপাতালের ক্যানসার ভবনে আল্ট্রাসনোগ্রাম বিভাগে রোগীর ভিড়ের কারণে বাগবিতণ্ডা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে দুইজনকে আটক করে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়।


দুদকের অনুসন্ধানে সারাদেশে ভয়াবহ অনিয়ম

বিএমইউর ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দুদক সারাদেশে ৪১ জেলার ৬৮টি সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অভিযান ও গোপন অনুসন্ধান চালিয়ে ভয়াবহ অনিয়মের তথ্য পেয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে—

  • রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা খাবার কম দেওয়া ও নিম্নমানের হওয়া

  • নির্ধারিত ওষুধ না দিয়ে বাইরের দোকান থেকে কিনতে বাধ্য করা

  • চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকা

  • কেনাকাটা ও নিয়োগে অনিয়ম

  • দায়িত্বে অবহেলা ও ঘুষ লেনদেন

  • অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহারের মতো গুরুতর অভিযোগ

নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখা যায়, ডায়েট চার্টে নির্ধারিত ২০০ গ্রাম মাছের পরিবর্তে রোগীদের দেওয়া হচ্ছে মাত্র ৫০ গ্রাম। ঝিনাইদহের মহেশপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র চারজন, জেনারেটর নষ্ট এবং সিজার কার্যক্রম বন্ধ।

নওগাঁর মহাদেবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখা গেছে, হাসপাতালটি নোংরা, বাথরুম ব্যবহার অনুপযোগী এবং চিকিৎসকরা বায়োমেট্রিক হাজিরা তালিকায় নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীরা অভিযোগ করেন, সরকারি ওষুধ না দিয়ে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বলা হয়, যেখানে চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন নিচ্ছেন।

এমনই চিত্র পাওয়া গেছে যশোর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর ও রাজশাহীতেও। রাজশাহীর পবা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগ নিরীক্ষার ফি কাঁচা রসিদে আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।


প্রকল্পেও অনিয়ম, ৫০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

দুদক সূত্রে জানা যায়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৩৩৪ কোটি টাকার প্রকল্প এবং ১৫টি মেডিকেল কলেজ ও ৪৪টি জেলায় ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন প্রকল্পেও অনিয়মের অনুসন্ধান চলছে। রাঙামাটি, ঝিনাইদহ ও যশোরে এসব প্রকল্পে ইতোমধ্যে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।

গত ৯ মাসে এসব অনিয়মের ঘটনায় প্রায় ৫০ জন চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং কয়েকজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানায় দুদক।

দুদকের উপ-পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, “এনফোর্সমেন্ট টিম অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”


‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,
“সরকারি হাসপাতালগুলোর অনিয়ম নতুন কিছু নয়। এখন প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, যাতে কেউ এমন কাজ করার সাহস না পায়।”

তবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান বলেন, “দুদক এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব বিষয়ে কিছু জানায়নি। জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”


উপসংহার

দেশের সরকারি স্বাস্থ্যখাতে চলমান এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা প্রমাণ করে—যতদিন পর্যন্ত জবাবদিহি ও শাস্তির সংস্কৃতি গড়ে না তোলা যাবে, ততদিন নাগরিকের মৌলিক অধিকার ‘চিকিৎসা’ অধরাই থেকে যাবে।