
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের বড় সফলতার কথা অনেক নেতাকর্মীর মুখে-মুখে থাকলেও এবারের নির্বাচন তাদের হতাশ করেছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয়ের বিপরীতে বিএনপির এই সহযোগী সংগঠনের একেবারে শূন্য হাতে ফেরায় স্তম্ভিত হয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে তৎপর হয়েছেন শীর্ষ নেতারা। সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের বিভাজন আর ‘মাই ম্যান’ দিয়ে কমিটি করার অভিযোগ খোদ নেতাকর্মীদের মুখে। ছাত্রদলের এমন ভরাডুবি শুধু ক্যাম্পাস রাজনীতিই নয়, মূল দল বিএনপির জন্যও বড় সতর্ক সংকেত বলে মনে করছেন দলটির অনেকে।ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মী বলছেন, ৯০-এর দশকের গণআন্দোলনের পর থেকে যে রাজনৈতিক ঐতিহ্য নিয়ে চলতো ছাত্রদল, শিবিরের ভূমিধস বিজয়ের বিপরীতে ডাকসুতে তাদের শূন্য হাতে আসা ছাত্রদলের সেই ঐতিহ্য অনেকটা ম্লান হয়েছে। ক্ষুণ্ন হয়েছে ভাবমূর্তি। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে। ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে সংগঠন গোছাতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ অবস্থার তৈরি হতে পারে আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
ডাকসু নির্বাচনে ফলাফল বিপর্যয়ের পর ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মামুন খান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কোনো মন্তব্য নেই। গভীর উপলব্ধি করতে হবে। দলীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে জরুরি সংস্কার প্রয়োজন।’
ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসানুল বান্না দলের পদ-পদবী দেওয়ার ক্ষেত্রে অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কথা তুলে ধরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে ফেসবুকে খোলা চিঠি লিখেছেন।
সামাজিক মাধ্যমে লেখা চিঠিতে বান্না লিখেছেন, ‘এভাবেই চলছে। বিশ্বাস করুন এভাবেই চলছে। একটা অদৃশ্য সিন্ডিকেট এসব নিয়ন্ত্রণ করে। একটা পোস্ট পেতে হলে, এদের গুডবুকে থাকতে হয়। নিজের কাজ, ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এদের তোষামোদি করতে হয়। আপনি বিশ্বাস করে যাদের দায়িত্ব দেন, তারা নিজের বলয় তৈরি করে। দলের স্বার্থ ত্যাগ, শ্রম, মেধা, ক্রিয়েটিভিটি কোনকিছুই এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।’গত মঙ্গলবারের ডাকসু নির্বাচনে ২৮টি পদে লড়াই করে ছাত্রদল কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমাতে পারেনি। সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)- সবগুলোতেই শিবির সমর্থিত প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন। বিপরীতে ছাত্রদলের প্রার্থীদের ভোটের সংখ্যা ছিল হতাশ হওয়ার মতো।
কেন এমন ভরাডুবি?
এদিকে ডাকসুর ভোটের রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তখন ফলাফল ঘোষণা না হওয়ায় পরিস্থিতি বৈঠক চলাকালে অনুধাবন করতে পারেনি দলের হাইকমান্ড। ফলে এ নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
তবে ফলাফল ঘোষণার পর এমন পরিস্থিতি নিয়ে দলের মধ্যে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। সাবেক ছাত্রনেতারা ইতোমধ্যে বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপি ও ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিজেদের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবির বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে বড় আকারে চিহ্নিত করা হয়েছে- হল কমিটিতে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে ভাগাভাগি করে পদ দেওয়া, প্রার্থীরা ক্যাম্পাসে অপরিচিত মুখ, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ কম থাকা, ছাত্রদলের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সিন্ডেকেটকে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থী তালিকা করা, নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে শিবিরকে জিতিয়ে আনতে জামায়াতের তুলনায় ছাত্রদল বিএনপির সাপোর্ট পায়নি। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনকে সেই অর্থে গুরুত্ব দেয়া হয়নি এমন আলোচনাও আছে।
বিএনপির হাইকমান্ডে চিন্তার ভাঁজ
এদিকে এমন ফলাফলের পর বিএনপির ভেতরে গভীর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। ছাত্ররাজনীতি শুধু ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্র নয়, জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের অন্যতম বড় হাতিয়ার। ছাত্রদলের এমন ভরাডুবি তাই বিএনপির জন্য রাজনৈতিক সংকেত।
বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও ছাত্রদলকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেইভাবে সমন্বয়ও করা হয়নি। নির্বাচনের ফলাফল আমাদের বড় ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের যে ফলাফল এটা নিয়ে আমরা কনসার্ন। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগও এসেছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চয়ই আলাপ-আলোচনা হবে। ভবিষ্যতে কীভাবে কী করতে হয় সেসব নিয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এর আগে এক অনুষ্ঠানে ডাকসুতে ছাত্রদলের এমন ফলাফল নিয়ে বিএনপির এই নেত্রী বলেছেন, পতিত সরকারের দোসরদের কারণে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের ভরাডুবি হয়েছে। এই নির্বাচন বিএনপিকে একটি সতর্ক সংকেত দিয়েছে।