
জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশের ছাত্র-রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা হয়ে থাকবে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হলেও এটি দ্রুতই রূপ নেয় ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে, যার পরিণতিতে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে এক ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক অধ্যায়ের অবসান ঘটে।এ আন্দোলনের এক অনালোচিত অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব সক্রিয়তা ও বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ। যারা এতদিন পর্যন্ত ‘রাজনৈতিকভাবে উদাসীন’ ও ‘আত্মকেন্দ্রিক’ ভাবমূর্তির চৌকাঠে বন্দি ছিলেন, তাদের হাত ধরেই আন্দোলন পায় নতুন গতি, সাহস এবং বিস্তৃত শক্তি।১৬ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল বন্ধের পর কার্যত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই আন্দোলনকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি মাথা হয়, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিল এর মেরুদণ্ড। তারা সব ভয়-ডর উপেক্ষা করে অসম্ভব ক্ষিপ্রতা নিয়ে রাস্তায় নামলে, আন্দোলনের কারিগররা অসম্ভবকে সম্ভব করার মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। এক পর্যায়ে স্কুল-কলেজের ছোট ছোট শিক্ষার্থী পর্যন্ত ভয়কে জয় করে মাঠে নামে দলে দলে এবং পরে সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে শরিক হলে পতন ঘটে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের।
এ আন্দোলনে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জন শিক্ষার্থী নিহত এবং ৩ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে আন্দোলনে অংশ নেওয়া বেসরকারি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানা যায়, অনেক শিক্ষার্থী নিজেরাই চিকিৎসা নেওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কতজন নিহত ও আহত হয়েছেন, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানুষ এক সময় ‘ফার্মের মুরগি’ বলে কটাক্ষ করতেন, তারা কী করে জুলাই আন্দোলনে হঠাৎ করেই এমন অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ২০১৫ সালের ‘নো-ভ্যাট’ আন্দোলনের ইতিহাস ঘাটতে হবে। সে সময় প্রথম দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার ওপর আরোপিত প্রত্যাহারের দাবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ-আন্দোলন করেন এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের আক্রমণের শিকারও হন। এই আন্দোলনের ফলে তৎকালীন অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভ্যাট প্রত্যাহারের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে বাধ্য হয়।
২০১৮ সালে বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত হয় ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’। ঢাকায় ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত এবং ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হলে এই সড়ক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ও তাদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিলেন।
একইভাবে ২০১৮ সালে প্রথম দেশে সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অংশ নেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে সে সময় তাদের অংশগ্রহণ সেভাবে প্রচার-প্রচারণা পায়নি। আগের আন্দোলনগুলোতে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং সাংগঠনিকভাবেও তারা নিজেদের গোছানো শুরু করে, যার ফল দেখা যায় জুলাই আন্দোলনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণে।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘১৭ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলন পাবলিক ইউনিভার্সিটির কন্ট্রোলে ছিল, ১৮ জুলাই থেকে মাঠের পুরোটাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর কন্ট্রোলে চলে গিয়েছিল। ১৮ জুলাই থেকে তাদের অবদানটাই সবচেয়ে বেশি ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানুষের ধারণা হচ্ছে তারা আত্মকেন্দ্রিক, তবে জুলাই আন্দোলনেই কিন্তু তারা প্রথম রাস্তায় নামেনি, এর আগে ‘নো-ভ্যাট’ আন্দোলন কিন্তু তারাই করেছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা ছিল, পরে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে তারা যুক্ত হয়েছেন। যদিও সেটা সেভাবে প্রচারণা পায়নি। পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের কারণে সেটা আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। ফলে জুলাই আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণটা ওই ধারাবাহিকতার ফল, এটা হঠাৎ করে হয়নি। আমরাই তাদের বুঝতে ভুল করেছি। আমরা ভাবতাম, তারা সবাই উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান, ফলে তারা নিজেদের নিয়েই থাকতে পছন্দ করে, যা একদমই সঠিক নয়। ’
২০২৪ সালের জুন মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এ আন্দোলন প্রথম শুরু হয়েছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। ৫ জুন সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করে রায় প্রকাশ করেছিলেন হাইকোর্ট। এ রায়ের পর পরই ৬ জুন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জুলাইয়ের শুরুতে আন্দোলন দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৫ জুলাই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলে আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।১৭ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। এরপর আন্দোলনকে কার্যত টিকিয়ে রাখেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের খুব বেশি শিক্ষার্থী কোটা ব্যবহার করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করে না বলে কোটা নিয়ে আন্দোলনের প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল না। তবে আন্দোলনের বেশ কিছু আক্রমণের ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর, বিশেষ করে আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের ওপর আক্রমণ ও নিপীড়নের ঘটনা তাদের প্রচণ্ড আঘাত করে। তখন পুরো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে ১৮ জুলাই মাঠে নামেন।
স্টুডেন্ট অ্যাক্টিভিস্ট ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. মুশতাক তাহমিদ জুলাই আন্দোলনের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে বাংলানিউজকে বলেন, ‘১৭ জুলাই অনির্দিষ্টকালের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার বদলে ছড়িয়ে পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ১৭ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার প্রতিবাদে সারাদেশে আন্দোলনের ঘোষণা দেন। আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম নিজের জন্য নয়; বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার আদায়ের জন্য। ’
জুলাই আন্দোলনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশায় দেশ না পৌঁছানোয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপেক্ষিত রাখায় হতাশাও প্রকাশ করেন এই অ্যাক্টিভিস্ট ও শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে সম্মান ও ন্যায্য স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল, তা পুরোপুরি মেলেনি। আমার জানা মতে, এ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ জন শিক্ষার্থী নিহত হন। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহতের সংখ্যা ১৩ জন। অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যেই তিনজন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি ছিলেন, তাদের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নেই। এমনকি সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরেও আমাদের কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আসলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ গণ-অভ্যুত্থানে সংগ্রাম করে কোনো স্বার্থ ছাড়াই ক্লাসে ফিরে গিয়েছেন। ’
এর আগে ১৫ জুলাই থেকে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি), ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিছিল হয়। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ শহীদ হলে, তা সারাদেশের মানুষকে নাড়া দেয়। ওই ঘটনার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশ (পুসাব) মাঠে নামার ঘোষণা দেয়।
১৮ ও ১৯ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর নজিরবিহীন হামলা চালায় পুলিশ। এদিন ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়, যা এ আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৮ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী উপায়ন্তর না পেয়ে শহর ছেড়ে যাওয়ার যে সময় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় রাষ্ট্র ও সরকারকে প্রত্যাঘাত করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ঢাকার উত্তরা, মেরুল বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, ধানমন্ডি, মিরপুর, নীলক্ষেত, তেজগাঁও, শান্তিনগর, মহাখালী, শনির আখড়া, কাজলা, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় এদিন ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। রামপুরায় বিটিভি ভবনে হামলা হয়। মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের কার্যালয়সহ কয়েকটি পুলিশ বক্স এবং বনানী সেতু ভবনের সামনে থাকা বেশ কিছু গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তর অংশে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (এনএসইউ), আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (এআইইউবি), ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি), ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নতুন বাজারে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে ও কুড়িল বিশ্বরোডে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলনে নামেন।
একই সময়ে বাড্ডায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও রামপুরা ব্রিজে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। অবরোধে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সসহ (ইউআইটিএস) আশপাশের সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরপর তিনটি মূল পয়েন্টে অবরোধের ফলে কার্যত উত্তর ঢাকা ও ব্যস্ততম কূটনীতিকপাড়া অচল হয়ে পড়ে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় আতঙ্ক ছড়ায় চতুর্দিকে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ অবস্থান নিলে বাধে আরো সংঘর্ষ।
সারাদেশে সংঘর্ষে সেদিন ২৭ জন শহীদ হন। আহত হন প্রায় দেড় হাজার। সেদিন রাতেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। এর আগে ১৭ জুলাই রাতে মোবাইলফোন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ১৮ জুলাই দেশ পুরোপুরি ইন্টারনেটবিহীন হয়ে পড়ে।
পরের দিন ১৯ জুলাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে হামলা করলে পাশে দাঁড়াতে নর্থ সাউথ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল, ইনডিপেনডেন্ট, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সসহ অন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে রামপুরার উদ্দেশে যাত্রা করলে মধ্যবাড্ডায় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে।
একইদিন মিরপুরে বিইউবিটি, বিইউপিসহ আশপাশের কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা হয়। এয়ারপোর্ট এলাকায় ঢাল হয়ে দাঁড়ায় নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। উত্তরায় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম, উত্তরা ইউনিভার্সিটি; মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, সংসদ ভবন এলাকায় ইউল্যাব, ইউডা, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। বাড্ডা ও উত্তরা এলাকায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
অন্যদিকে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় পুরো রাজধানীর রাস্তা অবরোধ করেন। এতে ব্যাপক সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। অনেক শিক্ষার্থী নিহত ও আহত হন। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় বিজিসি ট্রাস্ট ও প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, রাজশাহীতে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনায় নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
এ ঘটনার পর ১৯ জুলাইও আন্দোলন অব্যাহত রাখেন শিক্ষার্থীরা। এদিন সারা দেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৬৭ জন মারা যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি করা হয়। তবে কারফিউ উপেক্ষা করেই বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীরা। ২৪ জুলাইয়ের পর পুলিশের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, এ সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আশপাশের এলাকায় প্রায় নিয়মিতই ব্লক রেইড দেওয়া হতো। যাতায়াতের পথে শিক্ষার্থীদের ফোন চেক করা হতো এবং আন্দোলনে যুক্ত থাকার কোনো তথ্যপ্রমাণ পেলেই তাকে আটক দেখানো হতো। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন শিক্ষকরাও।
২৯ জুলাই থেকে শিক্ষকরা সরাসরি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে শুরু করেন এবং এর পর থেকেই পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলন আবারো জোরদার হতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত সভায়ও ছিল বেসরকারি শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি। সর্বশেষ ৫ আগস্ট লং মার্চ ঘোষণা করা হলে কারফিউ উপেক্ষা করেই জড়ো হন শিক্ষার্থীরা এবং ছাত্র-জনতা মিলে প্রায় কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভ মিছিল শাহবাগের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এদিনই দুপুরে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক নড়াচড়ায় যখন কোনো কিছুই টলানো যাচ্ছিল না, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক দখলের প্রত্যাঘাত, জীবনবাজি রাখা, শহীদ হওয়া ছিল ঐতিহাসিক ও অভূতপূর্ব বড় ঘটনা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জুলাইয়ে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়–সংক্রান্ত ইতিহাসের সব মিথ ভেঙে দিয়েছিল। ধসিয়ে দিয়েছিল পাবলিক-প্রাইভেট শ্রেণিভেদের বাইনারি। গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বিগত সব অবজ্ঞার ভাষা।
জুলাই আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর করা রাষ্ট্রের নির্যাতনের প্রতিবাদে রাস্তায় নামা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষার্থীরা হারিয়েছেন তাদের অনেক বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের। এখনো সেই নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার ঘটেছে। তারা রাষ্ট্রের কাছে এই আন্দোলনে ঘটা নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের দ্রুত বিচার দাবি করেন।
যদিও জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার পরও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপেক্ষিত রয়ে গেছেন। তাদের ভাগ্যে জোটেনি আনুষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি। তারা কোনো স্বীকৃতির আশায় আন্দোলন না করলেও বছর ঘুরে জুলাই ফিরে আসায় তাদের অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির বিষয়টিও সামনে এসেছে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রদের অনেকেই বিষয়টিকে সামনে এনেছেন। এসব শিক্ষার্থীরা জানান, জুলাই আন্দোলনে তাদের সক্রিয় ও জোরালো ভূমিকা থাকার পরও তারা উপেক্ষিতই রয়ে গেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তারা মনে করেন, রাষ্ট্রীয় কোনো কাজে তাদের যুক্ত না করার বিষয়টি অনুতাপের।