আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি প্রশ্ন—কে হচ্ছেন দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী? নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগেই রাজধানীর রাজনীতিক, কূটনীতিক ও বিশ্লেষক মহলে এই প্রশ্ন ঘুরছে নানা দিক থেকে। কেউ বলছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপতি হবেন বেগম খালেদা জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, খালেদা জিয়া সুস্থ থাকলে তিনিই আবারও হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।
পূর্ব অভিজ্ঞতা ও নতুন প্রেক্ষাপট
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকার এক অভিজাত হোটেলে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বিদেশি কূটনীতিকরা। তাঁদের সরাসরি প্রশ্ন ছিল—বিএনপি সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন?
তখন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছিলেন কারাগারে, আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে; ফলে স্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি নেতারা।
সাত বছর পর সেই প্রশ্ন আবার ফিরে এসেছে। তবে এবার শুধু বিএনপি নয়—সম্ভাব্য অন্য দল বা জোট থেকেও কে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী যদি ফেব্রুয়ারিতেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে এই আলোচনা আরও জোরদার হবে।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ হিসাব-নিকাশ
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকেই বিএনপি ক্ষমতার আলোচনায় এগিয়ে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেন,
“আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যদি সুস্থ থাকেন এবং কাজ করার উপযোগী থাকেন, তাহলে তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে আমাদের চেয়ারম্যান তারেক রহমান হবেন। এ বিষয়ে দলের ভেতরে কোনো দ্বিমত নেই।”
দলের ভেতরের অনেকের মতে, বিএনপি যদি সরকার গঠনের সুযোগ পায়, তবে ক্ষমতার বিন্যাসে কিছুটা সৌদি আরবের ‘বাদশাহ–রাজপুত্র’ মডেল অনুসরণ করা হতে পারে—খালেদা জিয়া থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর আসনে, আর তারেক রহমান হবেন নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনিক পরামর্শদাতা।
অন্যদিকে দলের তরুণ প্রজন্মের একাংশ বিশ্বাস করে, তারেক রহমানের নেতৃত্বেই বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি আরও আধুনিক ও গতিশীল হবে।
জামায়াত ও এনসিপির অবস্থান
ধর্মভিত্তিক বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন—এ বিষয়ে এখনো কোনো ঘোষণা দেয়নি দলটি।
দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন,
“নির্বাচন হোক, নির্বাচনে কারা নির্বাচিত হয়—তারপর দেখা যাবে।”
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), যা জুলাই অভ্যুত্থানের পর তরুণদের উদ্যমে গঠিত, তারাও ক্ষমতার আলোচনায় রয়েছে। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন জানান,
“আমরা দলীয় প্রধান ও সরকার প্রধানকে আলাদা রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সরকার গঠন করতে পারলে কে সরকারপ্রধান হবেন—এ মুহূর্তে তা বলা ঠিক হবে না।”
আওয়ামী লীগের অনিশ্চয়তা
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় দেশ কার্যত একদলীয় শাসনের অধীনে ছিল, যেখানে আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দলটি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এবং বর্তমানে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমও নিষিদ্ধ।
দল পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও শেখ হাসিনা আবারও নেতৃত্ব দেবেন কি না, নাকি নতুন নেতৃত্ব উঠে আসবে—সে বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। ফলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী নিয়ে আলোচনা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত।
বিশ্লেষকদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘প্রধানমন্ত্রী কে হবেন’ প্রশ্নটি কেবল ব্যক্তি বা দলের নয়—এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, নেতৃত্বের স্বচ্ছতা এবং দলীয় নীতিরও পরীক্ষা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন,
“এই মুহূর্তে তিনটি রাজনৈতিক দলের সরকার গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি দল ১০ থেকে ১৫টি আসন পেতে পারে, আরেকটি দল হয়তো কোথাও আসন পাবে না। একমাত্র বিএনপি থেকেই আগামী সরকারপ্রধান নির্ধারিত হতে পারেন। খালেদা জিয়া সুস্থ থাকলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা সম্ভব না হলে তারেক রহমানই নেতৃত্ব দেবেন।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোবাশ্বের হোসেন টুটুল বলেন,
“সরকারপ্রধানের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণাবলি সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর নাম জনসমক্ষে থাকলে ভোটারদের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এতে নেতৃত্বের জবাবদিহিতা বাড়ে।”
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন,
“যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে নেতৃত্বের অস্থিরতার কারণে টরিদের একাধিক প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন করতে হয়েছে, যার ফলে তারা সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর নাম প্রকাশ করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা।”
উপসংহার
বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলই আনুষ্ঠানিকভাবে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি—শুধু বিএনপি কিছুটা স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে। ফলে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের রূপরেখা এখনো অনিশ্চিত। কূটনৈতিক মহল, গণমাধ্যম ও বিশ্লেষকরা নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কিন্তু চূড়ান্ত উত্তর এখনো অমীমাংসিত।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা (১৯৭১–২০২৪)
| নাম | মেয়াদকাল | দল |
|---|---|---|
| তাজউদ্দীন আহমদ | ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ – ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ | আওয়ামী লীগ |
| শেখ মুজিবুর রহমান | ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ – ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৫ | আওয়ামী লীগ |
| মো. মনসুর আলী | ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ – ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ | আওয়ামী লীগ |
| মশিউর রহমান | ২৯ জুন ১৯৭৮ – ১২ মার্চ ১৯৭৯ | জাগদল / বিএনপি |
| শাহ আজিজুর রহমান | ১৫ এপ্রিল ১৯৭৯ – ২৪ মার্চ ১৯৮২ | বিএনপি |
| আতাউর রহমান খান | ৩০ মার্চ ১৯৮৪ – ১৫ জানুয়ারি ১৯৮৫ | জাতীয় পার্টি / জনদল |
| মিজানুর রহমান চৌধুরী | ৯ জুলাই ১৯৮৬ – ২৭ মার্চ ১৯৮৮ | জাতীয় পার্টি |
| মওদুদ আহমদ | ২৭ মার্চ ১৯৮৮ – ১২ আগস্ট ১৯৮৯ | জাতীয় পার্টি |
| কাজী জাফর আহমেদ | ১২ আগস্ট ১৯৮৯ – ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ | জাতীয় পার্টি |
| খালেদা জিয়া | ২০ মার্চ ১৯৯১ – ১৯৯৬ (স্বল্পমেয়াদ) ও ২০০১ | বিএনপি |
| শেখ হাসিনা | ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ | আওয়ামী লীগ |