বাজারে ভোক্তাদের স্বস্তি ফেরাতে গত আড়াই মাসে ছয়টি নিত্যপণ্যে শুল্কছাড় দিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। চাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু ও ডিমে শুল্ক–কর ছাড় দেওয়া হলেও শুধু দাম কমেছে ডিমের। বেড়েছে চাল, তেল ও চিনির দাম। স্থিতিশীল রয়েছে আলু ও পেঁয়াজের দাম। ছয় পণ্যে শুল্ক–করে ছাড় থাকলেও বেশির ভাগ পণ্যের দাম বাড়তি। সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কছাড়ে কেনা অধিকাংশ পণ্য দেশে এসে পৌঁছায়নি, যে কারণে দাম কমছে না। বিগত কয়েকদিনে আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। অন্য পণ্যের চড়া দামের কারণ দেশের সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এছাড়া কিছু পণ্যের জন্য অসময়ে বৃষ্টি ও বন্যাকে দায়ী করছেন তারা।তবে ভোক্তারা বলছেন, এসব পণ্যের দাম কমাতে বাজারে সরকারের কড়া নজরদারি নেই। নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি চক্র ‘কারসাজি’ করে দাম বাড়াচ্ছে সরকারের সুবিধা নেওয়ার পরেও। গুদামে গুদামে অভিযান চালিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
চালের দাম বাড়ার পরে শুল্কছাড়
উত্তরাঞ্চলে বন্যার পর থেকে মোকামে চালের দাম বাড়তি। যার প্রভাবে চলতি সপ্তাহে ঢাকার বাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যেই রোববার (১৬ অক্টোবর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর শুল্ক কমিয়েছে। এনবিআর জানায়, বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো ও চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।চাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান তিন ধরনের শুল্ক কমানো হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ২৫ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২০ শতাংশ কমিয়ে ২৫ থেকে করা হয়েছে ৫ শতাংশ। এছাড়া আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। চাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক-কর কমানোর ফলে আমদানি পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম ১৪ টাকা ৪০ পয়সা কমবে।এ বিষয়ে চাল ব্যবসায়ী সমিতির নেতা কাওসার আলম বলেন, ‘দেশে এখন বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির প্রয়োজন হয় না। এমন অবস্থায় চাল আমদানিতে শুল্ক কমানো হলো। এখন হয়তো ভারত-মিয়ানমার থেকে চাল আসবে। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ। ফলে বাজারে এর প্রভাব পড়তে সময় লাগবে।’বিগত জুলাই-আগস্টে দেশে আন্দোলন চলা অবস্থায় পরিবহন সংকট ও নানা কারণে এক দফা বাড়ার পর এখন আবার নতুন করে বেড়েছে চালের দাম। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে বাজারে বিভিন্ন ধরনের চালের দাম কেজিতে দুই থেকে চার টাকা বেড়েছে।বাজার ঘুরে দেখা যায়, আগে যে সরু চাল ৭২-৭৪ টাকা বিক্রি হতো সেটা এখন ৭৪-৭৮ টাকা, মাঝারি চাল ৬২-৬৬ টাকার বদলে ৬৪-৭০ টাকায় উঠেছে।ব্যবসায়ীদের অধিকাংশের দাবি, উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে চালের দর বাড়ছে।
তেল-চিনির দাম কমা সময়সাপেক্ষ
মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার ভোজ্যতেল ও চিনিতে শুল্ক–কর ছাড় দিয়েছে। তবে এর প্রভাব এখনো বাজারে পড়েনি। উল্টো খোলাবাজারে পণ্য দুটির দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহে চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ৩-৪ টাকা। তেলের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি ৫ টাকা।
সরকার ৮ ও ১৭ অক্টোবর দুই দফায় চিনির শুল্ক–কর কমায়। সবশেষ দফায় এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চিনি আমদানিতে খরচ কমবে কমবেশি ১১ টাকা। এছাড়া পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম তেলের ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এবং পরিশোধিত ও অপরিশোধিত পাম তেলের আমদানি পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে তেলের দামও বেশ কমার কথা।এ দুটি পণ্য প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। বর্তমানে বছরে ২০ লাখ টন করে তেল-চিনি আমদানি হয়।
দাম কবে কমবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘এখনো শুল্কছাড়ে কেনা পণ্য বাজারে আসেনি। সময় লাগবে। ওইসব পণ্য এলে দাম কমবে।তিনি বলেন, ‘পাঁচ-ছয়দিন হলো শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববাজারে তেলের দাম টনপ্রতি ১০০ ডলার বেড়ে এখন সাড়ে ১১শ ডলার ছাড়িয়েছে। আমরা এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার চাপে রয়েছি।’বাজারে এখন খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৫৩-১৫৬ টাকা ও পাম তেল ১৪৮-১৫১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তেলের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি ৫ টাকা। এছাড়া চিনির দাম তিন-চার টাকা বেড়ে খুচরা পর্যায়ে বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৩০-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কিছুটা কমেছে ডিমের দাম
তেল-চিনির সঙ্গে ডিমেরও শুল্কছাড় দেওয়া হয়। ডিম আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আমদানি শুল্ক কমানোর ফলে প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৩ দশমিক ৮০ টাকা খরচ কমেছে। এতে এর মধ্যে বাজারে দামও কমে এসেছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পাইকারি বাজারে প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল ১৩২-১৩৫ টাকা। খুচরা বাজারে এই ডিম বিক্রি হয় ১৬০-১৬৫ টাকায়। সপ্তাহখানেক আগেও ঢাকার বিভিন্ন বাজারে ডিমের ডজন ছিল ১৮০ টাকা।সংশ্লিষ্টরা জানান, শুল্কছাড়ের পাশাপাশি উৎপাদন পর্যায়ে দাম কমে আসায় বাজারে ডিমের দাম কিছুটা কমেছে।আলু-পেঁয়াজে শুল্কছাড়ে স্থিতিশীল
অন্তর্র্বতী সরকার সর্বপ্রথম নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আলু ও পেঁয়াজের দাম কমাতে আমদানি শুল্কছাড় দিয়েছিল। গত ৫ সেপ্টেম্বর আলু আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে আলু আমদানিতে যে ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আছে, তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। পেঁয়াজের ওপর প্রযোজ্য ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কও সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়।
এরপর দেশে এ দুই পণ্যের দাম না কমলেও বাড়েনি।
বাজার তথ্য বলছে, শুল্ক কমানোর আগেও বাজারে এক কেজি আলু বিক্রি হতো ৫৫-৬০ টাকায়। এখনো তা বিক্রি হচ্ছে ওই দামে। একইভাবে শুল্ক কমানোর আগে ও পরে পেঁয়াজের দাম ১১০ থেকে ১২০ টাকায় আটকে রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, যা ৯০-১০০ টাকার মধ্যে কেনা যাচ্ছে।
দাম নিয়ন্ত্রণে দরকার কঠোর নজরদারি
বাজারে ভোক্তারা বলছেন, শুল্কছাড়ের পরেও যেসব পণ্যের দাম কমছে না সেগুলোতে সরকারের কড়া নজরদারি দরকার। দাম কমাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি চক্র ‘কারসাজি’ করে দাম বাড়াচ্ছে।
সেলিম হোসেন নামে এক ক্রেতা শান্তিনগর বাজারে এসে বলেন, ‘শুল্ক কমালে সাধারণত দেশের বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ে। দাম কমে। আমাদের দেশে সেটার প্রভাব দেখা যায় না। কিন্তু বাড়লে সেটা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে যায়। কোম্পানি এখন বলছে-শুল্কছাড়ে কেনা পণ্য এনে কমে বিক্রি করবে, কিন্তু বাড়লে তখন সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দেয়।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘শুধু শুল্ক কমানো নয়, ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে হলে কঠোরভাবে কোম্পানিগুলোকে মনিটরিং করতে হবে। বাজারও তদারকি করতে হবে নিয়মিত। কারণ আমাদের সব শ্রেণির ব্যবসায়ীর অতি মুনাফার প্রবণতা রয়েছে।