
নব্বইয়ের দশকে ঢাকার অপরাধ জগতে আতঙ্কের নাম ছিল সুব্রত বাইন। যার ভয়ে কাঁপতো রাজধানীর অলিগলি। সুব্রত বাইনের ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপের কারণে সবসময় তটস্থ থাকতেন মগবাজার, পুরান ঢাকা ও মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ীরা। সুব্রত বাইনের বাবা ছিলেন একটি এনজিওর গাড়ি চালক। তিনি নিজেও মগবাজারের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেন ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একজন। আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ অপরাধী হিসেবে পরিচিতি পান।সেই সুব্রত বাইন এবং সহযোগী মোল্লা মাসুদসহ চারজনকে কুষ্টিয়া থেকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনী। ফলে নতুন করে আলোচনায় এসেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নাম।কে এই সুব্রত বাইন ২০০৩ সাল পর্যন্ত সুব্রত বাইন ঢাকার অপরাধ জগতের প্রভাবশালী চক্র 'সেভেন স্টার' গ্রুপের প্রধান ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় কমপক্ষে ৩০টি খুনের মামলা রয়েছে। ২০০৩ সালে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। মাঝে তিনি তেমন আলোচনায় ছিলেন না। তবে ২০১৭ সালের পর থেকে থেকে আবার আলোচনায় আসেন এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। এরপর থেকে ঢাকায় বিভিন্ন খুন ও অপরাধের সঙ্গে সুব্রত বাইনের লোকজনের সম্পৃক্ততা পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব অপরাধের নেপথ্যে থাকতেন সুব্রত বাইন।
সুব্রত বাইনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার বেড়ে ওঠা ঢাকার মগবাজারে। পরে তার পরিবার গাজীপুরের পুবাইলের পুবাইল হারবাইদ নয়াপাড়ায় জমি কিনে বাড়ি করে। বর্তমানে সেখানেই সুব্রত বাইনের বাবা ও মা এবং পরিবারের সদস্যরা থাকেন।সুব্রত বাইনের বাবার নাম বিপুল বাইন। তিনি একটি এনজিওর গাড়িচালক ছিলেন। মা কুমুলিনি বাইন। তারা এক ভাই ও তিন বোন ছিলেন। সুব্রত সবার বড়। তার তিন বোন হলেন মেরি বাইন, চেরি সুপর্ণা বাইন এবং সুপ্রভা পরি। চেরি ঢাকার একটি হাসপাতালে এবং পরি একটি ক্রিশ্চিয়ান সংস্থায় কাজ করেন। ছোট বোন সুপ্রভা পরির সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বিরোধ থাকায় পরিবারের কারও যোগাযোগ ছিল না।সুব্রত বাইনের বাবার গ্রামের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার জোবারপাড় গ্রামে। জানা গেছে, সুব্রত বাইন তিনটি বিয়ে করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশে দুটি এবং পশ্চিমবঙ্গে একটি। তার প্রথম স্ত্রী লুসি। এই ঘরে তার দুটি সন্তান রয়েছে। সুব্রত বাইন জেল থেকে বের হওয়ার পর তার প্রথম স্ত্রী লুসিকে তার গ্রুপের এক যুবকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। দ্বিতীয় স্ত্রী সুইটি। তার সাথে সুব্রত বাইনের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তৃতীয় স্ত্রী জামেলা খাতুন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া এলাকার মেয়ে এবং তার সাথেই সুব্রত বাইন শেষ কয়েক বছর ধরে ছিলেন।
যেভাবে উত্থান সুব্রত বাইনের
সুব্রত বাইন ১৯৯০-এর দশকে ঢাকার অপরাধ জগতে নিজের স্থান তৈরি করেন। ১৯৯১ সালে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদকে হত্যার মধ্য দিয়ে সুব্রত বাইন একজন নামকরা সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক খুন, চাঁদাবাজি, ভূমি দখলসহ অসংখ্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। তার নেতৃত্বে গঠিত 'সেভেন স্টার' গ্রুপ একসময় ঢাকার অপরাধ জগতে ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিল। এই গ্রুপের মাধ্যমেই তিনি তার অপরাধের জাল বিস্তার করেন।১৯৯৭ সালে ২১ বছর বয়সী রাজীব নামের এক যুবককে নৃশংসভাবে হত্যায় সুব্রত বাইনের 'সেভেন স্টার' গ্রুপের হাত ছিল। এই ধরনের অসংখ্য খুন, চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিজের প্রভাব বিস্তার করেন। ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার যে ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা ঘোষণা করেছিল, সেই তালিকায় সুব্রত বাইনও ছিলেন। তাকে ধরিয়ে দিতে তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তার নামে এখনো ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি রয়েছে।
অপরাধের ফিরিস্তি
শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের বিরুদ্ধে ৩০টি হত্যা মামলার অভিযোগের পাশাপাশি আরও নানা অভিযোগ রয়েছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম সদস্য হওয়ায় তার নামে গত প্রায় এক দশক ধরে ঢাকায় চলছিল নীরব চাঁদাবাজি। ঢাকার ব্যবসায়ী মহলে তার চাঁদাবাজির ব্যাপক প্রভাব ছিল। বড় অঙ্কের চাঁদা দাবি করতেন তার লোকজন। পরে হুন্ডির মাধ্যমে সেই টাকা সংগ্রহ করতেন সুব্রত। পাশাপাশি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের নেতৃত্ব দিতেন তিনি। তার সহযোগীদের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি। সুব্রত বাইনের নেতৃত্বাধীন 'সেভেন স্টার' গ্রুপ একসময় ঢাকার অপরাধ জগতের এক মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল। এটি কেবল একটি গ্যাং ছিল না, বরং সুব্রত বাইনের অপরাধ সাম্রাজ্যের মূল ভিত্তি ছিল। নব্বইয়ের দশকে এই গ্রুপটি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। ’সেভেন স্টার' নামটি তাদের কুখ্যাত কার্যকলাপের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এই গ্রুপটি মূলত হত্যা, চাঁদাবাজি, ভূমি দখল এবং অবৈধ অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা ধরনের গুরুতর অপরাধে জড়িত ছিল।
সুব্রত বাইন নিজেই অন্তত ৩০টি খুনের মামলার আসামি, যার বেশিরভাগই এই গ্রুপের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ঢাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিরা এই গ্রুপের চাঁদাবাজির শিকার হতেন। এই গ্রুপটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, এটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 'সেভেন স্টার' গ্রুপের সদস্যরা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ ও নৃশংস ছিল।সুব্রত বাইন পলাতক থাকা অবস্থায়ও এই গ্রুপের কিছু সদস্য তার নির্দেশনায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেত বলে অভিযোগ রয়েছে। সুব্রত বাইনের গ্রেফতারের পর 'সেভেন স্টার' গ্রুপের কার্যক্রম চলে কি না সেটাই দেখার অপেক্ষা।
পলাতক জীবন ও গ্রেফতার
গ্রেফতার এড়াতে সুব্রত বাইন ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ভারতে তিনি ব্যবসা গড়ে তোলেন। ২০০৮ সালে কলকাতার পুলিশ তাকে একবার গ্রেফতার করে। পরের বছর তিনি জামিন পেয়ে নেপালে পালিয়ে যান। ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স কর্মকর্তারা পিছু ধাওয়া করলে সুব্রত বাইন নেপাল সীমান্তের কাকরভিটা শহরে ঢুকে পড়েন এবং নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তাকে প্রকাশ্যে অশোভন আচরণের দায়ে পূর্ব নেপালের ভাদ্রপুর জেলে রাখা হয়। পরে ঝুমকা কারাগারে নেওয়া হয়। এরপর আবারও তিনি পলাতক হন।
সবশেষ মঙ্গলবার (২৭ মে) দুপুরে কুষ্টিয়ার একটি বাসা থেকে তার সহযোগী মোল্লা মাসুদসহ সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল তাকে গ্রেফতার করেছে। এসময় তাদের কাছ থেকে দুটি পিস্তল, চারটি ম্যাগাজিন এবং ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।