ঢাকা, রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪,
সময়: ১০:৫৯:০১ PM

বগুড়া সমবায় ব্যাংক যেন দলীয় কার্যালয় !

স্টাফ রিপোর্টার ।।দৈনিক সমবাংলা
10-11-2024 10:59:01 PM
বগুড়া সমবায় ব্যাংক যেন দলীয় কার্যালয় !

 সমবায় ব্যাংক একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। বগুড়া শহরের সাত মাথায় অবস্থিত এই ব্যাংকটি কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ঋণ দেয় । প্রতিদিন সেবা নেন অসংখ্য গ্রাহক। সরকারের তদারকিতে থাকা এমন একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানকে রীতিমতো রাজনৈতিক কার্যালয়ের মতো ব্যবহার করছেন ব্যাংকটির সাবেক সভাপতি ও জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ডাবলু। বর্তমান সভাপতির রুম ব্যবহারসহ কার্যালয়ে দিনে-রাতে চলছে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা বিনিময়, কেককাটা, সভা-সমাবেশ, আড্ডা। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকলেও বিষয়টি জানেন না বলে এড়িয়ে গেছেন জেলা সমবায় কর্মকর্তা।

জানা যায়, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন ডাবলু। তিনি সমবায় ব্যাংক বগুড়া কার্যালয়ের বর্তমান সভাপতি বিপাশা পিয়ারের স্বামী। তবে স্ত্রী সভাপতির পদে রয়েছেন শুধু কাগজে-কলমে। বাস্তবে ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ সবই করেন তিনি নিজে। শহরের রাজনীতির সমীকরণ ও নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের সমাধানও হয় এ ব্যাংক কার্যালয় থেকে।অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর বেহুলা বাসরঘর সমবায় সমিতি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক পদ দেখিয়ে প্রথম সমবায় ব্যাংকে যোগ দেন ডাবলু। তখন তিনি বগুড়া জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একই বছর ব্যাংকটির সভাপতি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ ব্যাংকের আওতায় বগুড়া জেলায় সমবায় সমিতি রয়েছে ৩৬টি। এর সদস্য সংখ্যা ৯ শতাধিক। তার স্ত্রী বিপাশা পিয়ার বর্তমানে দিগন্ত সমবায় সমিতি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি হিসেবে একই প্রক্রিয়ায় চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত। পরপর তিনবারের বেশি সভাপতি পদে থাকার নিয়ম না থাকায় তিনি স্ত্রীকে বসিয়ে নিয়ন্ত্রণ রেখেছেন । বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা এলাকায় অবস্থিত শতবর্ষের পুরোনো সমবায় ব্যাংক ভবনটি এখন বেশ জরাজীর্ণ। তবে ভবনে সভাপতির বসার জন্য নির্ধারিত কক্ষে গেলে চোখ আটকে যায়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এ কক্ষের অবস্থা দেখে ভবনটির জীর্ণদশা বোঝার উপায় নেই। ডাবলু ২০১১ সাল থেকে তিন দফায় ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকটির এ কার্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। নিয়ম অনুসারে চতুর্থবার সভাপতি হওয়ার সুযোগ না থাকায় এই দফায় সভাপতি করেন স্ত্রী বিপাশাকে। বিগত প্রায় তিন বছর বিপাশা এ দায়িত্ব পালন করলেও তিনি ব্যাংকে নিয়মিত নন। এমনকি ব্যাংকের সভাপতি পরিচিতি বোর্ডেও তার নাম উল্লেখ নেই।সম্প্রতি সমবায় ব্যাংকের বগুড়া কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যুবলীগ নেতাদের মিলনমেলা। ক্যাশিয়ার আব্দুল আলিম নিজেও যুবলীগ গোকুল ইউনিয়নের সদস্য। ডাবলুর ব্যক্তিগত কাজ করেন এনামুল হক নামে একজন। তিনি প্রথমে নিজেকে ব্যাংকের সুপারভাইজর হিসেবে পরিচয় দিলেও পরে যুবলীগ সদস্য বলে জানান। এছাড়া আরিফুল ইসলাম নামে আরও একজন সুপারভাইজার রয়েছেন যিনি যুবলীগ সদস্য বলে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেখানে কর্মরত অন্য স্টাফরা অনুপস্থিত থাকায় তাদের পরিচয় জানা যায়নি।

কয়েক মাস আগে ব্যাংকের মধ্যে বগুড়া জেলা যুবলীগ নেতাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করেন ডাবলু। সেখানে জেলার সভাপতি লিটন পোদ্দারসহ সব পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ ধরনের সভা, আড্ডাবাজি, শুভেচ্ছা বিনিময়, জন্মদিনের অনুষ্ঠান, কেককাটাসহ আনন্দ-বিনোদন সবই বিনা বাধায় চলে ব্যাংকের মধ্যেই। এরই মধ্যে যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামানের জন্মদিনের কেক কেটে আনন্দ করার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তিনি পুলিশের হাতে ইয়াবা ও হেরোইনসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন।এ বিষয়ে বগুড়া জেলা যুবলীগের সভাপতি লিটন পোদ্দার বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক বৈঠক নয়, সমবায় ব্যাংকে গিয়েছিলাম বিগত জেলা পরিষদের নির্বাচনে যুবলীগ কীভাবে কাজ করবে সে ব্যাপারে আলোচনা করতে। এছাড়া জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচনে যুবলীগের কার্যক্রম সম্পর্কে পরিকল্পনা ঠিক করার জন্যও সেখানে আরেক দফা বসা হয়েছিল।

শুধু ব্যাংক কার্যালয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নয়, সমবায়ের সম্পত্তির দেখভাল ও ভাড়া দেওয়া-নেওয়া স্ত্রীর পরিবর্তে করেন ডাবলু নিজেই। শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় ব্যাংকের জায়গায় একটি মার্কেট, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সূত্রাপুরের জমি, বাড়ি সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে। জানা যায়, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে ডাবলু পেয়েছিলেন পৈতৃক সূত্রে এক বিঘা জমি। চাকরি করতেন কলোনি টেকনিক্যাল কলেজে। সেসময় তিনি শহরের বৃন্দাবনপাড়ায় থাকতেন।নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবলীগের একাধিক সূত্র জানায়, ডাবলু সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর এই সাত বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ উন্নতি করেছেন। বগুড়া ভান্ডারী সিটি ওয়ানে প্রায় এক কোটি টাকার জায়গা কিনেছেন। গোকুলে নিজ গ্রামে চারতলা ভবনের নির্মাণকাজ চলমান। সেখানে ১৫ বিঘার ওপর জমি কিনে বাগান করেছেন। করতোয়া গেটলক নামে একটি বাসের মালিকানাও তার। আগে মালিক-শ্রমিক যৌথ কমিটি থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের উৎকোচ পেতেন। মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম নিশ্চিত করেন এ তথ্য।সমবায় ব্যাংককে রাজনৈতিক কার্যালয় বানানো প্রসঙ্গে বর্তমান সভাপতি বিপাশা পিয়ার বলেন, আমি মাঝে-মধ্যে মিটিংয়ে অংশ নিতে ব্যাংকে যাই। সেখানে বোর্ডে আমার নাম নেই, আমিও সেটি খেয়াল করেছি। আমার অবর্তমানে ডাবলু সেখানে বসতে পারেন। এছাড়া সাবেক সভাপতি হিসেবে তিনিই সব কাজ এখনো দেখভাল করেন।জানতে চাইলে বগুড়া জেলা সমবায় কর্মকর্তা মাসুদ পারভেজ জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। এ বিষয়ে কখনো কেউ তাকে অবগত করেননি। তবে ব্যাংকের মতো একটি স্পর্শকাতর স্থানে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে তিনি খোঁজ নিয়ে জানাবেন।অভিযোগের বিষয়ে বগুড়া জেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ডাবলু  বলেন, ব্যাংকে নিয়মিত বসলেও সভা-সমাবেশ করি এটি ঠিক নয়। স্থানটি আমার রাজনৈতিক কার্যালয়ও নয়। আর উল্লেখ করার মতো কোনো সম্পদ আমার নেই। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছু জমি রয়েছে। এছাড়া শহরে একটি জায়গা কিনেছি এবং গ্রামে বাড়ি করছি এটি সঠিক। তবে সরকারি কোনো সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করি না।