গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট নিশ্চিত করতে কুইক রেন্টালের মতো আরও অনেক বিতর্কিত আইন পাস করা হয় সংসদে।ক্ষমতাসীনদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং বিরোধী দলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিগত তিনটি সংসদে নানা বিতর্কিত আইন পাস করে আওয়ামী লীগ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট নিশ্চিত করতে কুইক রেন্টালের মতো আরও অনেক বিতর্কিত আইন পাস করা হয় সংসদে। এ ক্ষেত্রে নামমাত্র ক্ষুদ্র অবস্থানে থাকা বিরোধী দলের কিছুই করার ছিল না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকাও পালন করতে হয়েছে বিরোধী দলকে। হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকারি দল যেন এমন বিতর্কিত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তা বন্ধে সুপারিশ করতে যাচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে সংসদ সদস্যদের ‘ফ্লোর ক্রসিং’-এর সুযোগ রাখা হবে। ফলে সংসদে দলের প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিপক্ষে ভোট প্রদান করা হলেও কারও সংসদ সদস্য পদ খারিজ হয়ে যাবে না।বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ একটি বিতর্কিত ধারা, যা বাংলাদেশের সংসদে অতি-কঠোর দলীয় শৃঙ্খলা আরোপ করে। বাংলাদেশের সংসদকে ৭০ ধারার কারণে রাবার স্ট্যাম্প সংস্থা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ এমপিরা ফ্লোর অতিক্রম করতে বা বিবেকের ভোট দিতে পারেন না। সংসদ সদস্যরা নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে পারেন না। দল থেকে পদত্যাগ অথবা দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তাদের সংসদ সদস্য পদও থাকবে না বলেই বিধান রয়েছে। ফলে এ অনুচ্ছেদ বাতিল করলে দলের অন্যায় সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে সংসদ সদস্যরা নিজের বিবেকের কাছে ফিরে আসতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তাদের সংসদ সদস্য পদও বহাল থাকবে। এর মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।সংবিধান সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, কমিশন গঠনের পর বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় এবং জনমত গ্রহণের পাশাপাশি বিশ্বের ১২১টি দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করেছে অধ্যাপক আলী রিয়াজ নেতৃত্বাধীন ৯ সদস্যের এই কমিশন। তারই আলোকে সরকারের কাছে পেশ করার জন্য একগুচ্ছ সুপারিশমালা প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই তা আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্র্বতী সরকারপ্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধান পুনর্লিখন না করে সংবিধান সংশোধন করার ওপর গুরুত্বারোপ করবে সংস্কার কমিশন।
সূত্র আরও জানায়, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঠেকাতে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা এবং দুইবারের বেশি যেন কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, তা সুপারিশ করবে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান যেন একই ব্যক্তি না হন, এমন প্রস্তাবও থাকছে সুপারিশে। তরুণ নেতৃত্বকে অনুপ্রাণিত করতে সংসদ সদস্য পদে বয়সসীমা শিথিলের পরামর্শ থাকবে সংস্কার কমিশনের। সেক্ষেত্রে বর্তমান বয়সসীমা ২৫ বছরের পরিবর্তে ২১ বছর করার সুপারিশ করা হতে পারে। এ ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পরামর্শ থাকবে সুপারিশে। জাতীয় সংসদের বিদ্যমান ৫০ সংরক্ষিত আসনের পরিবর্তে নারীদের জন্য ১০০টি আসন সংরক্ষিত রাখার পরামর্শ থাকবে। এসব আসনে সরাসরি ভোটেরও পরামর্শ দেবে কমিশন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হতে পারে। এ ছাড়া সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং সরকারের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাবও করা হতে পারে।
এর আগে গত ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে ৯ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। সংস্কার কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ড. শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, লেখক ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী মো. মুস্তাইন বিল্লাহ এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি মো. মাহফুজ আলম। প্রজ্ঞাপনে সরকার জনপ্রতিনিধিত্ব ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে দেশের বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে এ কমিশন গঠন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সব মতামত বিবেচনা করে পরবর্তী ৯০ দিনের সময়সীমা মেনে ৭ জানুয়ারির মধ্যেই সুপারিশ জমা দেওয়া হতে পারে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী একক ক্ষমতার অধিকারী। এতে জবাবদিহিকে পাশ কাটিয়ে স্বৈরতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৬ বছরে আমরা ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের সর্বোচ্চ উদাহরণ দেখেছি। একজনের ইশারা ছাড়া যেন গাছের পাতাও নড়ত না। তিনি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা, দল নেতাসহ আরও অনেক পদে আসীন ছিলেন। অংশীজন এটি বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তি যেন এমন ক্ষমতার অধিকারী না হন, যেন তাকে প্রশ্ন করা যাবে না। সেই প্রশ্নগুলো করার জন্য ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি আসছে। তিনি আরও বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের ভূমিকার কথা মাথায় রেখে জাতীয় নির্বাচনে বয়স শিথিলের সুপারিশ আসতে পারে। এতে তরুণ প্রজন্ম জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ আরও উন্মোচন হবে।
কমিশনপ্রধান আলী রীয়াজ কালবেলাকে বলেন, কমিশন এরই মধ্যে রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তিনি বলেন, এককেন্দ্রীকরণের যে সমস্যা, আমাদের সেটি মোকাবিলা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জবাবদিহি তৈরি করা। যাতে করে প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তি, তিনি যেন এমন ক্ষমতার অধিকারী না হন, যেন তাকে প্রশ্ন করা যাবে না। সেই প্রশ্নগুলো করার জন্য ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি আসছে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদ আঁকড়ে ধরেন। ক্ষমতার এই ভারসাম্য শুধু রাষ্ট্রপতির সঙ্গে না করে সংসদের মধ্যেও করতে হবে। কেউ যেন দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হন, সেই ব্যাপারে আমরা ঐকমত্য দেখতে পেয়েছি। বিদ্যমান সংবিধানের বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলেরও সুপারিশ করবে এ কমিশন। কারণ, এ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের পায়ে বেড়ি লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সরকারের মেয়াদ, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণসহ বেশকিছু বিষয়ে মতামত পেয়েছে কমিশন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে এসব বিষয় থাকতে পারে বলেও জানান তিনি।