ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫,
সময়: ১০:৩০:০৭ PM

আন্দোলন চালিয়ে যেতে অবিচল ছিলেন নাহিদ

স্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
01-07-2025 05:03:16 PM
আন্দোলন চালিয়ে যেতে অবিচল ছিলেন নাহিদ

২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন নাহিদ ইসলাম। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর নজরদারি, শারীরিক ও অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও বৈষম্যমুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যেতে অবিচল ছিলেন তিনি।নাহিদ ইসলাম বলেন, আন্দোলনের একপর্যায়ে আমরা এমন সিদ্ধান্ত নিই যে, হয় আমরা বেঁচে থাকব, না হয় মরে যাব। বেঁচে থাকলে আমরা এই সরকারকে উৎখাত করব, আর নইলে আমাদের মৃত্যু হবে। আমরা এই ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতির মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক থেকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেন।

গত বছরের ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেখ হাসিনার পতনের জন্য এক দফা ঘোষণা করেন তিনি। সময়টি তার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। গুম, নির্যাতন, নজরদারি, হুমকি আর চোখের সামনে হাজারো মানুষের মৃত্যু অন্যদিকে স্বৈরাচারী সরকার থেকে মানুষের মুক্তি- এই দুইয়ের মধ্যে তাকে মানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পথটিই বেছে নিতে হয়েছিল। একদফা ঘোষণার পর মাত্র দুই দিনও টিকতে পারেনি ক্ষমতাধর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার। ৩৬ দিনের আন্দোলনের ফলে এ দেশের মানুষ স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ পায়।বাংলাদেশের ইতিহাস সৃষ্টিকারী এ ছাত্রনেতা, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা ও বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রতিবেদক আল সাদী ভূঁইয়াকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, গত বছরের ৫ জুন কোর্টের রায়ের পরে আমরা দেখলাম যে এটা শিক্ষার্থীদের ভেতরে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, তখন সবাই এর সংস্কার চেয়েছিল, বাতিল নয়। কিন্তু সরকার নিজে থেকে সকল কোটা বাতিল ঘোষণা করে। কিন্তু ২০২৪-এ এসে একটি একতরফা নির্বাচনের পর কোর্টের মাধ্যমে আবার কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়। সেটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনাস্থা, ক্ষোভ, হতাশা এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করে।’

‘এর মধ্যে দেশের অর্থনীতির অবস্থা ছিল টালমাটাল। আমরা যখন দেখলাম শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ আছে তখন সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে গিয়ে কথা বললাম। সবাই এ নিয়ে ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া জানাতে চাইল। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সন্ধ্যায় সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে একটি কর্মসূচি দিই। সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে সেদিন এর প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। প্রথম দাবিটি ছিল ২০১৮ সালের যে দাবি তা পুনর্বহাল করা। এ লক্ষ্যে ৫ জুন থেকে তিন দিন আন্দোলন চলে।’

আন্দোলনের শুরু ও বিস্তৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের তিন দিনের মধ্যে ঈদের বন্ধ চলে আসে। বন্ধের আগে আমরা অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়ে এসেছিলাম। প্রাথমিক দাবি ছিল যেন রায় স্থগিত করে পরিপত্র বহাল করার। ঈদের বন্ধ থাকায় আমরা একটা আলটিমেটাম দেই ৩০ জুন পর্যন্ত। যাতে এই সময়টার মধ্যে সরকার একটা ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু আমাদের ধারণা ছিল সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে না। এ কারণে আমরা এই সময়টাতে আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নিজেদের সংগঠিত করি।’

‘এদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই রায়ের বিরুদ্ধে এবং কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা অনলাইনে মিটিং করি, ফেসবুকে ক্যাম্পেইন করি। আমরা সকলের সঙ্গে একটা নেটওয়ার্ক স্থাপন করি। যখন আমরা দেখলাম সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত কোন কিছু করা হলো না তখন ১ জুলাই আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রথমবারের মতো কর্মসূচি পালন করি।’

‘এই সমন্বয়ক জানান, একই ব্যানারে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালিত হয়। আমরা এক থেকে চার জুলাই পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করি। ৪ জুলাই কোর্টের একটা রায় দেওয়ার কথা থাকলেও কোর্ট সেদিন কোনো বক্তব্য দেয়নি। এভাবে এটা পাঁচ-ছয় জুলাই পর্যন্ত চলে যায়। এরপর আমরা একটা পর্যায়ে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করি।’

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ নেতা বলেন, আমরা ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতি বরাবর একটা স্মারকলিপি দেই। এদিন একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। শেখ হাসিনা চীন সফরে ছিল। ফিরে ওইদিন সংবাদ সম্মেলন করে। সবার একটা প্রত্যাশা ছিল যে এতদিন টানা আন্দোলন চলেছে, তো শেখ হাসিনা দেশে এসে এবার এটার একটা সমাধান হয়তো দিতে পারে। তো সেই দিনের বক্তব্যের জন্য সবাই অপেক্ষা করে ছিল। কিন্তু দেখা গেল সে এসে কেবল এই আন্দোলনের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিল না বরং একে ‘রাজাকারদের আন্দোলন’ আখ্যা দিল।

তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী, তাদের অভিভাবক ও পরিবার সম্পর্কে অত্যন্ত মর্যাদাহানিকর কটু মন্তব্য করে। একটা ন্যায্য ও ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলন, যৌক্তিক আন্দোলন হওয়ার পরেও স্বৈরাচার হাসিনা তাদেরকে নিয়ে এভাবে কথা বলায় সবার আত্মমর্যাদায় লাগে। শিক্ষার্থীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। এইটা আমাদের কোনো পরিকল্পনায় ছিল না। পুরো বিষয়টাই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগায় সবাই এর বিরুদ্ধে কথা বলেছে। হলে হলে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেওয়া শুরু করে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখে আমরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি, ক্যাম্পাসে গিয়েছি। সবাইকে রাস্তায় নেমে আসতে আহ্বান করেছি। সকলেই খুবই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সে রাতে রাস্তায় নেমে আসে।’

আন্দোলনে হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা জানতাম যে আন্দোলনে কোনো একটা পর্যায়ে ছাত্রলীগ বা পুলিশ হামলা করবে। কারণ আমাদের আঠারো সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপত্তা সড়ক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছিল। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা দেখেছি, যে কোনো ন্যায্য আন্দোলনে এই সরকার ছাত্রদের ওপর কতটা দমনমূলক ছিল। ফলে আন্দোলনে হামলা আসবে এটার জন্য বা গ্রেপ্তার হতে পারি এ রকম একটা মানসিক প্রস্তুতিও আমাদের ছিল। কিন্তু সেই দিন (১৫ জুলাই) শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ যে ভয়াবহ হামলা চালায়, তার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কিংবা নারীদের ওপর এভাবে হামলা করবে তা আমরা ভাবতেও পারিনি।

সবসময় আমরা দেখেছি যে নারীদের বিষয়ে, মেয়ে আন্দোলনকারীদের বিষয়ে কিছুটা সতর্ক থাকা হয়। কিন্তু এইবার আমরা দেখলাম যে নারীদেরকে প্রথম এবং প্রধান টার্গেটে পরিণত করা হলো। মেয়েরা ব্যাপক ব্যাপক সংখ্যায় এ আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে এবং ভ্যানগার্ড হিসেবে ছিল। বাংলাদেশের কোনো ছাত্র আন্দোলনে এর আগে এত নারী অংশগ্রহণ করেছে কি না আমার জানা নেই। যেহেতু নারীদের অংশগ্রহণই এই আন্দোলনের অন্যতম ন্যায্যতা। সে কারণে নারীদেরকেই আক্রমণ করা হয়।

আন্দোলনের পটপরিবর্তন নিয়ে তিনি বলেন, এদিকে সেদিন ডিএমসিতে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) ঢুকে ব্যাপকভাবে আহতদের ওপরও হামলা করা হয় কয়েক দফায়। এই বর্বরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে লেখা থাকবে। আমরা জানতাম ছাত্রলীগ হামলা করবে কিন্তু এতটা বর্বর হবে, এতটা দমনমূলক হবে, এতটা হিংস্র হবে- এটা আমাদের ধারণায়ও ছিল না এবং এর প্রতিবাদে তো পরের দিন ১৬ তারিখ ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। সবাই রাস্তায় নেমে আসে। বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো ওইদিন ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এর এক-দুদিনের মাথায় আন্দোলন অন্যভাবে টার্ন নেয়।’

‘১৫ তারিখ আমাদের বোনেরা যেভাবে আহত হয়েছে তা ছিল ভয়াবহ। ১৬ তারিখ আবু সাঈদ শহীদ হলো। তার মৃত্যুর খবর আমি শহীদ মিনারে প্রথম ঘোষণা দিয়ে বলি, আমাদের এক ভাই শহীদ হয়েছে। এর আগের দিন আবু সাঈদের সঙ্গে বাকেরের কথা হয়। বাকেরের কাছে আবু সাঈদ জানতে চায় পরদিনের পরিকল্পনা কী? বাকের জানায়, আমরা মাঠে থাকব যে কোনো মূল্যে। আবু সাঈদ জীবন দিয়ে তার অটল সংকল্প প্রমাণ করছে- সে মাঠ ছাড়েনি, দাঁড়িয়ে ছিল বুলেটের সামনে। ওই ঘটনা আমাদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে, আলোড়িত করে।’

‘এই সময়টাতেই আমরা অনেকে ভেঙে পড়েছিলাম। একই সঙ্গে আবার ক্ষুব্ধও হই। ক্ষুব্ধতার মাত্রা অনেক বেড়ে যায় এবং এই লড়াই যে একটা চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিকে যাবে, এই একটা বোধ আমাদের ভেতরে ১৬ই জুলাই তৈরি হয়ে যায়। তখন আমরা শুনতে পেলাম রাত পর্যন্ত ছয়জন মারা গেছে। সেই রাতে আমি একটা ভিডিও বার্তা দিই। তখনই আমরা বুঝতে পারি যে এই আন্দোলন আর কেবল কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটা এখন আর কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নেই। যদিও কোটা সংস্কার প্রসঙ্গ থাকতেই পারে, তবুও এ আন্দোলনে যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তার ক্ষতিপূরণ অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন আমাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আমরা তো ১৬ জুলাই শহীদ মিনারে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছি এবং ১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজা ছিল। আন্দোলনটাও তখন আরেক দিকে মোড় নেওয়ার পথে ছিল।’

সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা বলেন, ‘এই পরিস্থিতি আঁচ করেই সরকার দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। আমরা যখন সকালে (১৭ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি, দেখি, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং অনেক হলের শিক্ষার্থীরা হল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ কেউ ইতোমধ্যে হল ছেড়ে চলে গেছে। আমরা হলে হলে গিয়ে সবাইকে থাকার অনুরোধ করি, সাহস দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি। এরপর ১৭ তারিখের কর্মসূচিতে আমাদের কিছু প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল। কারণ, ১৬ তারিখে রাজু ভাস্কর্য যাওয়া না যাওয়া নিয়ে একটা কনফিউশন তৈরি হয়েছিল। তার সঙ্গে ১৭ তারিখ আশুরা ছিল। সেদিন আমাদের একটু এলোমেলো দেখা যায়। তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকার আমাদের প্রস্তুতির ঘাটতির সুযোগ নেয়। তারা ক্যাম্পাস এলাকায় ব্যাপক মাত্রায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবসহ এমন কোনো বাহিনী ছিল না যাদের সেদিন মোতায়েন করেনি।’

‘কফিন মিছিল শুরু হলে তারা টিয়ারশেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড মারা শুরু করে। একপর্যায়ে আমরা হলে ফিরে যাই, হল পাড়ায় অবস্থান নিই। সেখানেও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর যখন দেখি আমাদের লোকবল খুবই কমে গেছে, অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে, তখন আমরা বুঝতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ওপর সরাসরি আক্রমণ চলছে। তখনই আমরা অনুরোধ জানাই, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একটা সময় শিক্ষার্থীরা শোকার্ত হয়ে বের হয়ে যায়। তখন ভাবি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে, আমরা মনে হয় আন্দোলনটা আর চালিয়ে যেতে পারব না। আন্দোলন হয়তো এখানেই শেষ। আমরা আর টানতে পারব না।’

‘এদিন রাতে (১৭ জুলাই) আমরা কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা দিই। এদিকে পরিস্থিতি দেখে মনে হয়েছে, এ আন্দোলন আমাদের পক্ষে টেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না যদি না সাধারণ মানুষ এ আন্দোলনে নামে। তবে পরদিন (১৮ জুলাই) দেখি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা শুরু করে। ১৮ তারিখ থেকে আন্দোলনটা একেবারে জনগণের কাতারে চলে আসে। এর মধ্যে (১৭ জুলাই সন্ধ্যায়) সরকার ঘোষণা দেয়, বুধবার রাত থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য কারফিউ চলবে। আমি তখন ঘোষণা দিই যে কারফিউর মধ্যেও আমাদের কমপ্লিট শাটডাউন অব্যাহত থাকবে।’

আন্দোলনের পর্যবেক্ষণ নিয়ে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সাবেক এ উপদেষ্টা বলেন, ‘১৮ তারিখ রাতে আমি যাত্রাবাড়ী ছিলাম। তখন আমরা পালিয়ে থেকে ফোন অফ করে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করছিলাম। বিভিন্নভাবে যোগাযোগগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করছিলাম। ১৯ তারিখ আমি ধানমন্ডি, বাড্ডা, রামপুরা এলাকা পর্যবেক্ষণ করি। ১৯ তারিখ রাতে আমি বনশ্রীর বাসায় আসি। বাসার পাশে আমার বন্ধুর বাসা। সেখান থেকে আমি মিটিং করি। সেদিন আমি বুঝতে পেরেছি আমাদেরকে মিডিয়া থেকে ব্লাকআউট করে ফেলা হয়েছে। মিডিয়ায় আমাদের কেনো নিউজ নেই। তখন মিডিয়ায় আমাদের নামে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর নিউজ ছড়ানো হয়। এ সময়ে আমি মোবাইল অন করি। সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই যা হওয়ার হবে, আমি পাবলিক থাকব। ২০ তারিখ আমি পুনরায় কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা দিই। তখন মিডিয়াকে আমি জানাই। যদিও সে নিউজ কোথাও প্রচার হয়নি। এদিকে সরকার ২০ তারিখ আবার কারফিউ ঘোষণা করে। তখন আমি ঘোষণা দেই কারফিউর মধ্যে শাটডাউন চলমান থাকবে। এটা ১৯ তারিখ রাতেই মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিই।

গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমি আগেই জানিয়েছিলাম যে আমাকে গ্রেপ্তারের শঙ্কা রয়েছে। মোবাইল ফোনে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। সেই রাতেই রাত দুটা বা আড়াইটার দিকে কিছু লোক ডিবি পরিচয়ে আমার বন্ধুর বাসায় আসে। তারা আমার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করে এবং তারপর আমাকে গাড়িতে তুলে নেয়, হ্যান্ডকাফ পরায় এবং চোখ বেঁধে দেয়। এরপর গাড়িতে তারা আমাকে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে আমার ওপর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ এবং শারীরিক ও অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ২১ তারিখ ভোরবেলা আমাকে পূর্বাচল এলাকায় ফেলে রেখে যায়। সেখান থেকে আমি হাসপাতালে যাই, পরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাই, কিন্তু সেখানেও পুরো হাসপাতালকে একপর্যায়ে নজরদারির আওতায় নিয়ে নেওয়া হয়। গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ আমাদের কাউকে যোগাযোগ করতে দিচ্ছিল না। আসিফ এবং বাকেরও একপর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন থেকেই আমরা আবার আন্দোলন বিষয়ে সবার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও দিকনির্দেশনা দিতে শুরু করি।’

তিনি বলেন, এই বিষয়টি নজরে আসতেই আমাদের আবার ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তখন থেকে ডিবি হেফাজতে থাকি। ডিবির হেফাজতে আমাদের ওপর নানা রকম চাপ প্রয়োগ করা হয় আন্দোলন বন্ধ করার জন্য। আমি সেখানে ছিলাম ছয় দিন। ডিবি অফিসে আমাদের প্রথমে আন্দোলন স্থগিত করতে বলা হয়। কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি। পরপর দুই দিন আমরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। এরপর আমাদের কয়েকজনের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বাড়ানো হয়। আমাদের পরিবার ও মেয়েদের গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়, এমনকি একজন মেয়েকে সত্যিই ডিবিতে নিয়ে আসা হয়। আমাদের পরিবারের সদস্যদের নানা ধরনের ভয়ভীতির মধ্যে রাখা হয়। হুমকি ও চাপপ্রয়োগের মাধ্যমে তারা আমাদের আন্দোলনটা স্থগিত করতে বলে। আমরা বলি, আন্দোলন শেষ করার ঘোষণা দেবো, তবে তা বাইরে গিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জানাবো। তবে তারা সেটা মানেনি। তারা আমাদের দিয়ে জোর করে ভিডিও স্টেটমেন্ট নেয়—যেখানে আন্দোলনের সমাপ্তির কথা বলতে বাধ্য করা হয় এবং বলা হয়, এই ভিডিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখানো হবে।’

নির্যাতনের মধ্যেও হার না মানার কথা জানিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এরপর আমাদের খাওয়ার সময় জোর করে খাওয়ানো হয়, এবং এই ভিডিও ছড়িয়ে আন্দোলন শেষ হয়েছে— এমন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু বাইরে যারা ছিল, তারা এসব বিশ্বাস করেনি। বরং তারা আন্দোলনকে আরও শক্তভাবে চালিয়ে যায়। ভেতরে থেকে একবার আমাদের মনে হয়েছিল যে আন্দোলনটা হয়তো শেষ হয়ে গেছে। ভেতরে থেকে কখনো খবর পেয়েছি, কখনো পাইনি। হাইকোর্ট বরাবর মার্চ হয়েছে সেটি আমরা বুঝতে পেরেছি। একসময় আমরা বুঝতে পেরেছি আমরা স্টেটমেন্ট দেওয়ার পর লোকজন বিশ্বাস করে নাই এবং আরও ব্যাপকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যায়। মানুষ অনেক ক্ষুব্ধ হয়ে গেছে। এবং তারা (ডিবি) আর মামলায় গ্রেপ্তারও দেখাতে পারবে না। এটা যখন আমরা বুঝতে পেরেছি তখন ডিবি অফিসের ভেতরে আমরা নীরব আন্দোলন শুরু করি। আমরা তাদের কোনো ধরনের ডিরেকশন মানছিলাম না। অনশন শুরু করি। তারা একটা সময় চেষ্টা করছিল আমাদেরকে সেখান থেকে শেখ হাসিনার অফিসে নিয়ে যাওয়ার। একপর্যায়ে অনশনের কারণে তারা আমাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।’

‘১ আগস্ট আমরা সেখান থেকে বের হই। তখন আমি অসুস্থ। ২ আগস্ট আমি বুঝতে পারলাম আন্দোলনটা যে মাত্রায় চলে গেছে এখন স্পষ্ট করে আমাদের অবস্থান জানাতে হবে। এত দিন কৌশলগতভাবে ৯ দফার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টা ছিল এ সরকারকে আমরা মানি না। যখন আন্দোলনটা এই পর্যায়ে চলে গেছে আমরাও বুঝতে পারছিলাম আমাদেরকে একটা শেষ পরিণতির ঘোষণা দিতে হবে। তখন আমরা আবারও যোগাযোগ তৈরি করি যারা বাইরে আন্দোলনটা পরিচালনা করছিল তাদের সাথে। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে ৩ আগস্ট আমরা এক দফার ঘোষণা দেবো। সে পরিপ্রেক্ষিতে ৩ তারিখে শহীদ মিনারে ঐতিহাসিক এক দফার ঘোষণাটা দিই।’

তিনি বলেন, ‘সেদিন আমরা যে চূড়ান্ত ঘোষণার দিকে চলে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে আমাদের আর পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না। এটা আমরা জেনে শুনেই চূড়ান্ত অবস্থায় গেছি। ফলে ৪ আগস্ট বা আরও পরে ব্যাপক ভয়াবহতা আসবে তা আমরা জানতাম এবং সেটা গৃহযুদ্ধের দিকেও যেতে পারে। এটাও আমার আশঙ্কা হচ্ছিল। হয় আমরা বেঁচে থাকব, না হয় মরে যাব। বেঁচে থাকলে আমরা এই সরকারকে উৎখাত করব, আর নইলে আমাদের মৃত্যু হবে। আমরা এই ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতির মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।

একদফার ঘোষক বলেন, ‘৪ তারিখেই আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম যে প্রয়োজনে অস্ত্রও তুলে নিতে পারি। সেদিনই সারাদেশে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায় এবং হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আমরা ৬ তারিখে লংমার্চের ঘোষণা দিলেও ৪ তারিখের ভয়াবহতা দেখে বুঝে যাই, সরকার ইন্টারনেট আবার বন্ধ করে দেবে এবং আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। ফলে আমরা কর্মসূচিটা (লংমার্চ) একদিন আগে নিয়ে আসি। যাতে করে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে কোনো ধরনের পরিকল্পনা করার সুযোগ না পায়।’

সরকার পতন আন্দোলনের এ মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা ৪ তারিখ রাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা করছিলাম। ঢাকার কতগুলো পয়েন্ট থেকে আন্দোলনকারীরা আসবে। গণভবন কীভাবে ঘেরাও হবে। বা এই সরকারের পতনের পর আমরা কী করব। ৩ আগস্টের পর থেকেই এ আলোচনাগুলো শুরু হয়ে যায়। ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে আলোচনা হয়। সরকারের রূপরেখা কেমন হতে পারে। কে হতে পারে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, অন্য উপদেষ্টারা কারা হবেন এসব বিষয় নিয়ে আমরা পুরো ব্যস্ত ছিলাম। ৩ আগস্ট থেকে আমাদের মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস চলে এসেছিল যে সরকারের পতন হবে। কবে হবে, কীভাবে হবে তা হয়তো নিশ্চিত ছিলাম না।’

তিনি বলেন, ‘৫ তারিখে যে সরকারের পতন হবে তাও নিশ্চিত ছিলাম না। যেহেতু ৪ তারিখ সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হলো তাই ৫ তারিখ সেনাবাহিনী কী ভূমিকা নেয় সেটাও দেখার বিষয় ছিল। জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে এ লড়াইয়ে আরও রক্তপাত হবে। লড়াই আরও দীর্ঘ হবে। আর যদি সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে দাঁড়ায় তাহলে এ লড়াইটা হয়তো শেষ হয়ে যাবে। আমরা দেখলাম যে সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সৈনিকরা, তরুণ অফিসাররা জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমরা যখন শাহবাগ থেকে গণভবনের দিকে মার্চ করা শুরু করি আর ওইদিকে উত্তরার দিক থেকে মানুষ আসা শুরু করে, তখন আমরা শুনতে পাই শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। আমরা এটা দুপুর একটা-দুইটার দিকে শুনতে পাই সাংবাদিকদের মাধ্যমে।’

শেষ পর্যন্ত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে। রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিকামী মানুষের অপ্রতিরোধ্য স্রোত। আন্দোলনের সাফল্য উদযাপনে বিজয় মিছিলে মেতে ওঠে সারা দেশ।